[বিশিষ্ট গল্পকার, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, বহুমুখী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাফায়াত খান গত ৮ মে মাত্র ৬২ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রাম তথা দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গন শোকবিহ্বল। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর লেখা একটা ছোটগল্প এখানে পত্রস্থ করা হল।]
গরীবউল্লাহ শাহ এর মাজারের সামনে রাস্তায় কাফনের কাপড়ে আবৃত একটা মৃত দেহ। মুখটাই শুধু খোলা । অনেক লোকের জটলা। পথচারীরা কেউ এক টাকা পাঁচ টাকা ছুঁড়ে দিচ্ছে লাশের পাশে। টাকা তুলতে থাকা দুজনের কাছে লাশটার পরিচয় জানতে চায় অতনু। ওরা বললো রাস্তায় পড়ে ছিল একদিন, ওরা নিয়ে এসেছে এখানে দাফন করতে। অতনু কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে লাশটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো-- কে এই অজ্ঞাত? বেশ ভিড় জমে গেছে। যদি চেনা কেউ হয়! বলা যায় না, এমন পরিস্থিতি অতনুর জীবনেও ঘটতে পারে। ইদানীং এসব কি হচ্ছে চারপাশে। মানুষের জীবনের কোন মূল্য ই নেই যেন।
চোখ বোঁজা, দুই নাকের ছিদ্রে তুলো গোঁজা। নিথর দেহটার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকল ও, কর্পূর আর আতর লোবানের গন্ধ চারপাশে। না জানি কার সন্তান, স্বামী, পিতা, ভ্রাতা বেওয়ারিশ হয়ে দাফনের অপেক্ষায়। কাঁচাপাকা দাড়ি, কদিন শেভ না করা মুখ। অচেনা মুখ। এসব ভাবতে ভাবতে কিছু দূর এগিয়ে এসে যাত্রীর অপেক্ষায় থেমে থাকা বাসে উঠে পড়ে অতনু। পাশে পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল কবরস্থান। বাসের জানালা থেকে অনেক কবর দেখা যাচ্ছিল। কোনো কোনো কবর বাঁশের বেড়ায় নয়তো ইটের দেয়ালে ঘেরা। ধনী দরিদ্র পার্থক্যে মৃতের কি আসে যায়। তবুও মানুষ তার সামাজিক মর্যাদা ধনসম্পদের চিহ্নাদি রেখে যায় কবরে। সেই প্রাচীন মিশরের শ্রেণিবিভক্ত সমাজেরই প্রতিচ্ছবি যেন। সুযোগ পেলে পিরামিড করে রাখতো কবর। কারো শুধু মাটির স্তূপ, কারো বেড়া , কারো ইটের গাঁথুনি । ধনী-দরিদ্র পার্থক্য বুঝতে কষ্ট হয়না। অতনুদের অবশ্য কবরের দরকার পড়ে না, দহনেই সমাপ্তি।
বাসটা লাশের কাছে এসে থেমেছে। সামনে গাড়ীর ভিড়। অতুনু জানালা দিয়ে নিচে তাকায় আবার । লাশটার চোখ খোলা। গাড়িতে ওঠার আগে লাশটার চোখ বোঁজা ছিল। অতনুর শরীরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কেমন অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বড়ই চেনা চেনা মনে হচ্ছে-- কোথায় যেন দেখেছে। কোথায়? চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে। কে লোকটা? খুবই পরিচিত। অথচ মনে করতে পারছে না। অতুনু কি বাস থেকে নেমে যাবে? নিশ্চয় কিছুক্ষণ পর মনে পড়বে। দেরি হলে লাশটা দাফন করে ফেলবে চাঁদাবাজরা। অতনু স্মৃতির কোলাহলে ডুব দেয়। যেমন করে হোক খুঁজে আনতে হবে পরিচয় । বাসটা চলতে শুরু করে। কবরস্থান পেছনে ফেলে আসতেই অতনু বিশ বছর আগে ফিরে যায়। লোকটা এমন একটি বাসেই ওর সহযাত্রী ছিল। লোকটি বেশ আলাপি, অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখে বাসায় ফিরছে। ওর কাজ, পরিবার নিয়ে অনেক কথা হলেও ঠিকানা জানা হয়নি। নিউমার্কেট এলে লোকটা নেমে যায় দ্রুত। গাড়ি থেকে নামার সময় হাসতে হাসতে বলেছিল, আবার দেখা হবে । এই কি সেই দেখা । বিশ বছর আগের সেই লোকটির মুখাবয়ব কী যেন বলছে। অতনু কি বাস থেকে নেমে যাবে। চোখ বন্ধ করে অতনু আবার ভাবতে থাকে; পড়তে থাকে লোকটার দৃষ্টির ভাষা। অতনুকে যেন বলছে, দাদা, আমাকে বাঁচান। মৃত লোকটির আকুতি ওকে বিহ্বল করে তোলে।
সারা পথে উশখুশ করে অতনু। সেদিন কেন লোকটার সাথে দেখা হলো। পাশের মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে নামাজের পরেই লোকটিকে দাফন করা হবে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে সামনের স্টপেজে নেমে যাবে অতনু। গাড়ির টিনের দরজায় হাতের তালু দিয়ে আঘাত করছে অল্পবয়সী ছেলেটা-- নামেন নামেন বলে যাত্রীদের ডাকছে । এখনই নামতে হবে অতনুকে। সেই আঘাত যেন অতনুর বুকের ভেতরকার হৃদপিণ্ডটাকে রক্তাক্ত করে তুলছে। দ্রুত সিট ছেড়ে উঠে পড়ে ও। পাশে বসা লোকটা ঝিমুচ্ছিল, অতুনুর হাঁটুর স্পর্শে জেগে উঠে চোখাচোখি হতেই অতনু ভয়ে শিউরে ওঠে। লাশ হওয়া কুড়ি বছর আগেকার সেই যাত্রী । লোকটা তার দিকে একপলক তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে চোখ সরিয়ে নেয়। অতনু পড়িমরি করে বেরিয়ে আসে বাস থেকে। অতনুর চোখ চলমান বাসের জানালায়-- লোকটার একপাশ দেখা গেল-- সেই চেনা চোখ-মুখ।
বাসটা অদৃশ্য হতেই অতনু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মাথাটা বনবন করে ঘুরছে, অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে অতনু। সেই মরা মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। ওর দিকে চেয়ে। দুচোখে কিসের আকুতি যেন। অতনু শুনতে পায় লোকটার ঠোট দুটো কেঁপে উঠলো-- দাদা, আমাকে বাঁ চা ন....। অতনু আর এগুতে পারে না। ধীরে ধীরে বসে পড়ে সে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ওর, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তার মাথাটা ইটের সাথে ধাক্কা খায়। শব্দটা শুনেই অতুনু চোখ মুদে ফেলে।
কোলাহলে অতনু জেগে উঠে। কয়েকজন লোক ওকে ঘিরে আছে। ওদের শুশ্রূষায় ও উঠে বসে। এক তরুণ ওর পিঠে পরম মমতায় হাত রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে। কোথায় যাবেন আপনি? সুস্থ বোধ করছেন কি? নাকি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো? আপনার ঠিকানাটা বলুন আমি পৌঁছে দেব। অতনুর ঠোট দুটো কেঁপে ওঠে-- ঠিকানাটা ও মনে করতে পারছে না। দুজনের কাঁধে হাত রেখে ও হাটছে সামনে এক অদৃশ্য ঠিকানার সন্ধানে।
মন্তব্য করুন