অবশেষে ফরাসি লেখিকা আনি এর্ন্যো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ২০২২ জিতে সবাইকে অবাক
করে দিয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের ১২২ বছরের ইতিহাসে সাহিত্যের মোট ১১৯ জন বিজয়ীর মধ্যে
১৭ জন মহিলা বিজয়ীর একজনে পরিণত হলেন এর্ন্যো।
৮২ বছর বয়সী এই কথাসাহিত্যিক সাহিত্যচর্চা করছেন গত অর্ধশতাব্দী ধরে। নোবেল পুরস্কার
কমিটি তাঁর সাহিত্যকর্মের উচ্চপ্রশংসা করে বলেছেন, আনি এর্ন্যো লেখেন “আপোষবিহীন এবং সহজ সরল, চাঁছাছোলা
ভাষায়”। লেখক হিসেবে তিনি যথেষ্ট সমাদৃত। সারাক্ষণই তিনি ভেঙে চলেছেন কল্পকাহিনি ও
সত্যকাহিনির মধ্যেকার সীমারেখা। নিজের লেখায় তিনি ব্যবচ্ছেদ করেছেন নিজের জীবনের, যৌনতার
আর রাজনৈতিক বাস্তবতার।
আনি এর্ন্যোকে বলা হচ্ছে “ফরাসি আত্মজৈবনিক কল্পকাহিনি (অটোফিকশান)’র অগ্রদূত”। তাঁর নির্বাচিত রচনাবলী, বিশেষ
করে তাঁর সেরা সৃষ্টি ‘লেজানে’ (বছরগুলো) বার বার উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। শেষোক্ত বইটি ২০১৯-এ বুকার পুরস্কারের
জন্যে শর্টলিস্টেড হয়েছিলো।
এর্ন্যোর লেখা যে সবসময় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অনুধাবন করা বা প্রশংসিত হয়েছে
তা কিন্তু নয়। দুবছর আগে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এর্ন্যো বলেছিলেন,
যখনই তাঁর কোনো লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সমালোচকরা অতিঅবশ্য সেটাকে ‘অশ্লীল’ বা ‘স্থূল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আর এই বিরূপ সমালোচনা শুধু তাঁর যৌনতাকেন্দ্রিক লেখালেখির জন্যেই নয়, আলঝেইমার
রোগের সঙ্গে তাঁর মায়ের লড়াইয়ের সময় এর্ন্যো যে ডায়েরি লিখেছেন, ১৯৯৭-এ তা পুস্তকাকারে
‘জ্যো ন্যো সুই পা সর্তি দ্য মা নুই’ (আমি আমার রাত্রি থেকে সরতে পারি
না) নামে প্রকাশিত হওয়ার পর সেটাকে অনুরূপ আখ্যা দেয়া হয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে
তিনি বলেন, “মানুষ সর্বত্র অশ্লীলতা দেখতে পায়। বাস্তবে এ প্রবণতার লক্ষ্য হলো শুধু মহিলারা।”
কিন্তু এখন, প্রথম বইটি বেরুনোর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এর্ন্যোকে ক্রমশ গুরুত্বের
সঙ্গে গণ্য করা হচ্ছে। শুরু থেকেই যে সম্মান ও স্বীকৃতি তাঁর পাওয়ার কথা ছিল, এখন তিনি
ধীরে ধীরে তা পাচ্ছেন।
সাহিত্যে এবারের নোবেল বিজয়িনী আনি এর্ন্যোর বিভিন্ন বই থেকে কয়েকটি উদ্ধরণযোগ্য
উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হল:
১.
লজ্জা বুঝতে পারার চাবিকাঠি পাওয়াটা লজ্জাকে মুছে ফেলার ক্ষমতা দেয় না। [মেমোয়ার
দ্য ফিইয়ে (কন্যার কাহিনি), ২০১৬]
২.
আমার শৈশবের সেই চোখ দুটো কোথায়, তার তিরিশ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর চোখ দুটো, যে
চোখগুলো আমাকে নির্মাণ করেছে? [জ্যো ন্যো সুই পা সর্তি দ্য মা নুই (আমি আমার রাত্রি
থেকে সরতে পারি না), ১৯৯৭]
৩.
আমার জীবনের সত্যিকারের উদ্দেশ্য হয়তো আমার শরীর, আমার অনুভূতি আর আমার চিন্তাগুলোর
লেখা হয়ে ওঠা, অন্য কথায়, বোধগম্য আর সর্বজনীন কিছু হয়ে ওঠা, যাতে আমার অস্তিত্ব অন্যদের
জীবনে আর মাথার মধ্যে মিশে যায়। [লি’ভেন্মঁ (ঘটনা), ২০০০]
৪.
এটা আবার পুরো খুঁজে নাও, পুরোটা স্মরণ করো, একসাথে যুক্ত করো পুরোটাকে, একটা
গাঁথা মালায়, একটার পর আরেকটা জিনিস সাজিয়ে। বুঝিয়ে দাও কেন আমি এখানে একটা ডর্মিটরির
নোংরা কামরায় আবদ্ধ হয়ে আছি, মৃত্যুর আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক নিয়ে। ভেবে বের করো,
এটার সবকিছুর মধ্যেকার সঙ্কোচনগুলোর একেবারে গভীরে চলে যাও। এই পুরো জঘন্য অবস্থাটার
সূত্রপাত কোথায় হয়েছিলো খুঁজে বের করো। [ফ্যার ভিদে (সাফাই করা), ১৯৯০]
৫.
মাত্র গত পরশু আমি আতঙ্কটা কাটিয়ে উঠেছি একটা সাদা পৃষ্ঠায় ‘আমার মা মারা গেছেন’ কথাটা লেখার ব্যাপারে, একটা চিঠির
প্রথম বাক্য হিসেবে নয়, একটা বইয়ের শুরুর বাক্য হিসেবে। [উইন ফাম (একজন নারী), ১৯৮৭]
৬.
তার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তার কথাগুলো, তার দুটো হাত, তার চলাফেরার ভঙ্গি আর হাসি
আজকের একজন নারীতে পরিণত আমাকে যুক্ত করলো একদা আমি যে শিশুটি ছিলাম, তার সাথে। আমার
আর আমি যে-জগতটা থেকে এসেছিলাম তার মধ্যেকার শেষ বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। [উইন ফাম (একজন
নারী), ১৯৮৭]
৭.
এসব জিনিস লিখতে আমি কোন লজ্জা বোধ করি না, কারণ যে-মুহূর্তটায় এগুলো লেখা হচ্ছে--
যখন কেবল আমিই সেগুলোকে দেখতে পাচ্ছি-- সেটাকে সময় আলাদা করেছে অন্যদের সেগুলো পড়ার
মুহূর্তটা থেকে, যে-মুহূর্তটা কখনো আসবে বলে আমার মনে হয় না। ততদিনে কোনো দুর্ঘটনায়
আমি মারাও যেতে পারি; একটা যুদ্ধ কিংবা বিপ্লব শুরু হয়ে যেতে পারে। এই দেরি হওয়াটার
কারণেই আমার পক্ষে আজকে এগুলো লেখা সম্ভব হচ্ছে, ঠিক যেভাবে আমার ষোলো বছর বয়সে আমি
সারাদিন কাঠফাটা রোদে শুয়ে থাকতাম, অথবা গর্ভনিরোধক ছাড়াই ভালোবাসাবাসি করতাম কুড়ি
বছর বয়সেঃ কোনো পরিণামের কথা না ভেবেই। [পাঁসিও সাঁপল (সাদাসিধে আবেগ), ১৯৯২]
৮.
কষ্টকে অটুট রাখা যায় না, তাকে ‘প্রক্রিয়াজাত’ করে নিতে হয়, কৌতুকে পরিণত করে
নিতে হয়। [জ্যো ন্যো সুই পা সর্তি দ্য মা নুই (আমি আমার রাত্রি থেকে সরতে পারি না),
১৯৯৭]
৯.
সে আমাকে শিখিয়েছে দুনিয়াটা বানানো হয়েছে ছোঁ মারার আর উপভোগের জন্যে, এবং এটার রাশ ধরে রাখার কোনো কারণ একেবারেই নেই। [লা ফাম জ্যোলে (সেই কামশীতল নারী), ১৯৮১]
মন্তব্য করুন