বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামী শিক্ষিত, শহুরে মায়েদের মুখে চাটগাঁইয়া ঘুমপাড়ানি গান একদম শোনা না গেলেও, গ্রামাঞ্চলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মায়েদের অনেকেই আজও এসব গান গেয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ায়। শহরে চট্টগ্রামী ঘুমপাড়ানি গানের জায়গা দখল করেছে প্রমিত বাংলার বা হিন্দি ভাষার ঘুমপাড়ানি গান আর ইংরেজি 'লালাবাই'।
পৃথিবীর সর্বত্র যেমন, চাটগেঁয়ে ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলোও অবশ্যই সুর করে গাওয়া হয়
নিদ্রাকর্ষণের সুবিধার্থে। এক্ষেত্রে ছড়ার কথাও সুরকে জোরালো সহায়তা দেয়।
চাটগাঁইয়া ঘুমপাড়ানি ছড়া:
১.
ঘুম দ্য'নি মাসি-পিসি আঁ'র-অ বাড়িত
আইয়,
খাট নাই, পালং নাই, চোগর উয়র বইয়।
বাডা ভরি পান দিয়ম, গাল ভরি খাইয়,
লাতুয়ার (বা লাতুরির) চোগৎ ঘুম
নাই,
ঘুম দি যাইয়।
প্রমিত বাংলায়:
ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি
এসো,
খাট নেই, পালঙ্ক নেই, চোখ পেতে ব'সো।
বাটা ভরা পান দেব, গাল ভরে খেয়ো,
খোকার (বা খুকির) চোখে ঘুম নেই, ঘুম দিয়ে যেয়ো।
[এটা একটি বহুল পরিচিত ও
প্রচলিত ঘুমপাড়ানি ছড়ার চাটগাঁইয়া রূপ। এখানে 'দ্য'নি' শব্দটার অর্থ হল 'যে দেয়'। 'ঘুম দ্য'নি' মানে 'যে ঘুম দেয়'। প্রমিত বাংলার 'খোকা-খুকু' চট্টগ্রামী বাংলায় 'লাতুয়া-লাতুরি'। 'লাতুয়া'র '-তুয়া' চাটগেঁয়ে ভাষায়
উচ্চারিত হয় হিন্দি 'ত্বা'-র মতো।]
২.
ঘুম যা রে দুধের বাছা,
ঘুম যা রে তুই,
কুশ্যাল বনৎ পইরগে হিয়াল,
দুঁ'রাই দিয়ম মুই।
প্রমিত বাংলায়:
ঘুম যা রে দুধের বাছা,
ঘুম যা রে তুই,
আখের বনে পড়েছে শেয়াল,
তাড়িয়ে দেব আমি।
[চাটগেঁয়ে ভাষায় আককে 'কুশ্যাল' বলা হয়। এ ছড়ার
তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তিতে পাঠভেদ আছে। 'কুশ্যাল বন'-এ 'হিয়াল' না পড়ে কখনো 'অঁ'লই গাছৎ
তোতা'
(আমলকি গাছে তোতা বা টিয়াপাখি) কিংবা কখনো 'লেচুগাছৎ বাদুর' (লিচুগাছে বাদুড়)-ও পড়ে থাকে। তবে যা-ই পড়ুক, 'দুধের বাছা'র কোনো ভাবনা নেই; সে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে।]
৩.
ঘুম যা রে দুধের বাছা,
ঘুম যা রে তুই,
ঘুমর তুন উডিলে বাছা
বস্তু (বা 'বচ্চু') দিয়ম মুই।
প্রমিত বাংলায়:
ঘুমা রে তুই দুধের বাছা,
ঘুমা রে তুই,
ঘুম থেকে উঠলে বাছা
বস্তু দেব আমি।
[এ ছড়া এক নং ছড়ার প্রায় অনুরূপ, তবে দুটোর বক্তব্য ভিন্ন। প্রথম ছড়ায় যেখানে শিশুর প্রিয়
আখের বন আর লিচুগাছ থেকে শেয়াল বা বাদুড় তাড়ানোর
প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিশুকে নিশ্চিন্ত করে তাকে ঘুমোতে বলা হচ্ছে, সেখানে দ্বিতীয় ছড়ায় বলা হচ্ছে, সে ঘুমিয়ে উঠলে পর তাকে বস্তু দেয়া হবে। 'বস্তু' হল শিশুদের আর
বড়দের মধ্যে বিনিময়ের একটি সাংকেতিক শব্দ। বস্তু মানে জিনিস, কিন্তু সে-জিনিস কী জিনিস কেবল তারাই জানে। এখানে বস্তু মানে হল শিশুদের
লোভনীয় কোনো খাবার বা খেলনাপাতি গোছের কিছু। ঘুমপাড়ানি সুরে গানটা গাওয়ার সময়
মায়েরা 'উচ্চারণকে আরো কোমল আদুরে করে 'বচ্চু' বলে থাকে।
৪.
অলি অলি অলি,
ভাইরগ্যা বাঁশর ঝলি।
ননাইর চোগৎ ঘুম নাই,
করে চতুরালি।
প্রমিত বাংলায়:
অলি অলি অলি (নিদ্রাকর্ষণী
অর্থহীন শব্দ),
ভারা বাঁশের ঘেরা।
খোকার (খুকির) চোখে ঘুম নেই,
করে চতুরালি।
['ঝলি' শব্দটি একান্ত একটি চাটগেঁয়ে শব্দ বলে মনে হয়, অথবা এটা শুদ্ধ বাংলার ‘ঝালর’ থেকেও আসতে পারে। ঝল অর্থ হল 'ঘেরা' বা 'আড়াল'। ভেতরবাড়ি বা
অন্দরমহলের পর্দা হিসেবে বাঁশের কঞ্চি ও পাতা, কলাপাতা, তালপাতা, নারকেল পাতা ইত্যাদি দিয়ে ঝালরের মতো করে
ঝলি দেয়া হয় চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে। 'ননাই' শব্দটি চট্টগ্রামে ব্যবহার করা হয় ছোট বাচ্চাদের আদুরে ডাক
হিসেবে। অর্থের দিক থেকে শব্দটি হিন্দি 'নন্হা' বা 'নন্না', স্পেনিশ 'নিনো' প্রভৃতির সমতুল্য। শব্দটি এসেছে হিন্দি 'নন্না' থেকে।]
৫.
অলি অলি অলি
চম্পা ফুলর কলি,
চম্পা ফুলে ঘিরি রাইখ্যে
আঁ'র নোনাইর ঝলি।
প্রমিত বাংলায়:
অলি অলি অলি,
চাঁপা ফুলের কলি,
চাঁপা ফুল ঘিরে রেখেছে
আমার বাছার বেড়া।
শিশু মনোরঞ্জক ছড়া
ছোট বাচ্চাদের খুশি করার জন্যে
মা-দিদি, ঠাকুমা-দিদিমারা কিছু ছড়া আউড়ে থাকে। এরকম
কয়েকটি ছড়া--
১.
এক্কানা মনার গুরগুরি ঠ্যাং,
কে'নে মনা রেঙ্গুন গেল্?!
হাতর বাঁশিউয়া ফালাই গেল্,
মা-বইনরে কাঁদাই গেল্।
প্রমিত বাংলায়:
একটুখানি মনার খুদে খুদে ঠ্যাং,
কেমনে মনা রেঙ্গুনে গেল?!
হাতের বাঁশিটা ফেলে গেল,
মা-বোনকে কাঁদিয়ে গেল।
[একটা শিশু যখন ছোট্ট দুটো পায়ে
দাঁড়িয়ে নতুন হাঁটতে শিখে টলতে টলতে খানিকটা এগিয়ে যায়, তখন বড়রা এ ছড়া বলে থাকে। এখানে 'গুরগুরি' কথাটা এসেছে 'গড়ি গুড়ি' থেকে, যার মানে হল 'ছোট ছোট' বা 'খুদে খুদে'। ছোট ছেলে চাটগাঁইয়া ভাষায় 'গুরি পোয়া'। প্রমিত বাংলাতেও 'ছোট
ছেলেপিলে' অর্থে 'গুঁড়োগাঁড়া' কথাটার ব্যবহার রয়েছে।
ছড়াটিতে চট্টগ্রামের একটা
সামাজিক ইতিহাসের চিহ্নও আছে। পুরোনো আমলে চট্টগ্রামের মানুষ জীবিকার্জনের জন্যে
ঢাকা-কলকাতার চেয়ে বেশি যেত পড়শি মায়ানমারের আকিয়াব-রেঙ্গুনে। পুরাতন গানে
চট্টগ্রামী নারী কেঁদে তার স্বামী বা প্রেমিককে বলছে: 'অ শ্যাম, রেঙ্গুন ন যাইয়' (ও শ্যাম, রেঙ্গুনে যেয়ো না)।
উল্লিখিত ছড়াটিতেও ছোট্ট মনা কী করে মা-বোনকে কাঁদিয়ে তার খুদে খুদে পায়ে হেঁটে অত
দূরে রেঙ্গুনে চলে গেল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। ]
২.
হাত ঘুরাইলে লাড়ু পাইবা,
নইলে লাড়ু কডে পাইবা?!
প্রমিত বাংলায়:
হাত ঘুরোলে নাড়ু পাবে,
নইলে নাড়ু কোথায় পাবে?!
[ছোট বাচ্চার সামনে হাত ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে এ ছড়া বলে তাদের আনন্দ দেয়া হয়। এটা প্রমিত বাংলার 'হাত ঘুরোলে নাড়ু পাবে'র
চট্টগ্রামী সংস্করণ। ]
৩.
নাচ ত মনা, নাচ ত চা'ই,
কে'নে নাচিব, কাপড় নাই।
প্রমিত বাংলায়:
নাচো তো মনা, নাচো তো দেখি,
কেমনে নাচবে, কাপড় নেই।
[খুদে ন্যাংটোপুটো বাচ্চাদের এ
ছড়া বললে তারা ফোকলা দাঁতে খিলখিলিয়ে হেসে নাচতে থাকে, পরনের কাপড়ের তোয়াক্কা না করেই।]
৪.
ধন ধন ধন
মানিক রতন,
এই ধন যার ঘরৎ নাই তার
কিয়র জীবন?
প্রমিত বাংলায়:
ধন ধন ধন
মানিক রতন,
এই ধন যার ঘরে নাই তার
কিসের জীবন।
আপাতত এখানেই ইতি। আগামীতে আবার
আপনাদের সামনে আসার ইচ্ছে রইল চট্টগ্রামের আরো ছড়া-শোলক নিয়ে।
মন্তব্য করুন