চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সাহিত্য

সেলিনা রহমান শেলী

আবেগের আরেক নাম হুমায়ুন আহমেদ


প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২০২২ জুলাই ১৯, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন

[আজ ১৯ জুলাই, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে নিচের লেখাটি পত্রস্থ করা হল।]

আবেগের আরেক নাম হুমায়ুন আহমেদ। একটা বয়স থাকে ভালো লাগার।একটা বয়স থাকে কল্পনার রাজ্য আবেগের রঙিন ঘুড়ি ওড়ানোর।

জি, আমি আমাদের কিশোর বা কিশোরী বয়সের কথা বলছি। আমাদের কিশোর বেলা এতোটা সুন্দর ছিলো যে, ঐ বয়সে আমরা লুকিয়ে বই পড়তাম।নায়ক নায়িকার দুঃখে চোখের কাজল ধুয়ে ফেলতাম।রাত জেগে গল্পের না পড়া অংশ নিয়ে চিন্তা করতাম।

হুমায়ুন আহমেদের লেখা বই যে বা যারা শুধু পড়ার জন্য পড়ে নাই, অন্তরে ধারন করেছে, একমাত্র তারাই অনুভব করবে কে হুমায়ুন? লেখার শক্তি ঠিক কতটা গভীর হলে একই বই পড়ে, একই সময়ে বাবা, মেয়ে  মুগ্ধ হতে পারে।

আমি বিশ্বাস করি, "হুমায়ুনের বই শুধু পড়লেই হয় না, তাকে অন্তরে ধারণ করতে হয়।"

আমার এই কথা পড়ে অনেকেই হয়তো মৃদু হাসি দিয়ে ঠোট ওল্টাবে। কিছু করার নাই জনাব।কথাটা আপনার কাছে বড় মনে হলেও আমি একজন হুমায়ুন ভক্ত হিসেবে বলতেই পারি।

আজ হুমায়ুন আহমেদ এর উপন্যাসের কিছু চরিত্র নিয়ে কথা বলব।

আমার দৃষ্টিতে হুমায়ুনের চরিত্রগুলো যেমন....

হিমুঃ

আমার মনে হয় হুমায়ুন আহমেদ এর সবচেয়ে জনপ্রিয়  চরিত্র হিমু। এর প্রমান আমি পাই, যখন ফেসবুকে শত শত হিমু আইডি দেখি।

যখন একটা ছেলেকে হলুদ পাঞ্জাবি পরে হিমু হওয়ার অভিনয় করতে দেখি।একটা জেনারেশন আছে যারা সব সময় মনে মনে হিমু হতে চেয়েছে,হিমু হতে চায় ।

 পকেট বিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে, খালি পায়ে অজানা কোন গন্তব্য হাঁটা দিতে চায়,  এমন যুবক খুব সহজে আমাদের চারপাশে খুঁজে পাওয়া যাবে ।

হিমুর রুপা হবার বাসনায় কত কত মেয়ে নীল শাড়ি পরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে চাঁদনি রাতে এ হিসেব আমিই দিতে পারবো।

এই যে, বর্তমান সময়ে যারা হিমু বা হিমুর রুপা হতে চায় তাদের ৬০% এর বেশি  হিমু সিরিজের বই পড়েছে বড়জোর ৩/৪ টি।  এটুকুও পড়েছে কি না সন্দেহ।

 তারপরও তারা হিমু হতে চায়।এই সাফল্য একমাত্র হুমায়ুন আহমেদের লেখনি শক্তির।

হিমু পড়ে আনন্দে হাসে নাই, কষ্টে চোখের পানি ফেলে নাই, সমস্যা সমাধানে হিমুর অপার্থিব শক্তিতে ভরসা করে নাই এমন হিমু পাঠক নেই।

আমার মনে হয় না বাংলা সাহিত্য  এমন কোন জনপ্রিয় চরিত্র আছে যাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের তরুণেরা অনুসরণ করেছে।

আমি অহংকার করেই বলছি আরও বেশ কিছু প্রজন্মের ছেলেরা স্ব-ইচ্ছায় হিমু হতে চাইবে।

মিসির আলিঃ

অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান চরিত্র মিসির আলি। গল্পের জটে যখন চুল ছিঁড়ে ফেলার অবস্থা পাঠকের। কাহিনীর করিডোরে বিভ্রান্ত পাঠককে যুক্তিসহ  প্রতিটা ঘটনা ব্যাখা করে সমাধানে নিয়ে আসেন এই অসাধারণ চরিত্র।

গোয়েন্দা চরিত্র অসংখ্য আছে আমাদের সাহিত্য। কিন্তু মিসির আলি চরিত্রটিকে কেনো যেনো শুধু গোয়েন্দা বা সমস্যার সমাধানদাতা হিসেবে আমরা পাঠকেরা চিন্তা করি না।

আমাদের মনে এক মানবিক মিসির আলি চলে আসেন।

নিশীথিনী বইয়ে কুঁড়িয়ে পাওয়া মেয়েটির প্রতি তার ভালোবাসা,দায়িত্ববোধ ব্যাখ্যাতীত। একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে অন্য রকম এক ঘোরের রাজ্য তৈরি করেন মিসির আলি।

কোন সমস্যায় পড়লে আমি অনেককেই বলতে শুনেছি,"আহা, মিসির আলি  থাকলে এক মুহূর্তে সমাধান করে দিতো।"

এই যে,মিসির আলির এই সফলতা এর সমস্ত কৃতিত্ব একজন হুমায়ুন আহমেদ এর।

শুভ্রঃ

 চশমা পড়া,অসম্ভব ফর্সা,লম্বা,চিকন, খুব পড়ুয়া, মায়ের বাধ্য ছেলে বলতেই আমাদের সামনে আসে শুভ্র নামে পরিচ্ছন্ন এক চরিত্র।

আমার মনে হয় হুমায়ুন আহমেদ তার ভালো লাগা জায়গা থেকে শুভ্র নামে এতো সুন্দর একটি চরিত্র তৈরি করেছেন।আমরা স্কুল, কলেজ জীবনে  চশমা পরা খুব সুদর্শন যুবক দেখলেই বান্ধবি বা বোনদের বলতাম,

" আরে ছেলেটা একদম শুভ্রর মত।" 

হুমায়ুন আহমেদ এই একটি চরিত্রকে অনেক ভাবে ভেঙেছেন, গড়েছেন। কিন্তু শুভ্রর অবয়বে অন্য কোন চরিত্রের ছায়া ফেলতে দেন নাই।

আমার কাছে এক কথায় শুভ্র হলো, "ভালোবাসার এক চরিত্র।মুগ্ধতার এক চরিত্র।"

শুভ্রর প্রতি তার মায়ের ভালোবাসা কোন এক অদ্ভুত উপায়ে লেখক হুমায়ুন পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। শুভ্র তো শুভ্রই।

হুমায়ুনের নায়িকাঃ

এই একটি জায়গায় আমি  নির্দিষ্ট কোন  চরিত্রের কথা বলব না। হুমায়ূনের নায়িকা বলতে বৃষ্টি বিলাসের 'শামা' , কোথাও কেউ নেই এর 'মনা' , দেবির 'রানু ও নীলু', শঙ্খ নীল কারাগারের 'রাবেয়া 'এমন অসংখ্য চরিত্রকে আমি একজন পাঠিকা হিসেবে আমার মাঝে ধারণ করেছি, ধারণ করছি,ভবিষ্যতেও করবো।

"একটা ছিলো সোনার কন্যা মেঘ বরন কেশ

ভাটি অঞ্চলে ছিলো সেই  কন্যার দেশ

দুই চোখে তার আহারি কি মায়া...."

এই গানটা হুমায়ুন কাকে নিয়ে লিখেছেন জানেন?

 আমাকে নিয়ে। এমন কথা শুধু মুখে না মনে ও আমি বিশ্বাস করি। হুমায়ুনের কিছু নায়িকা পরিবার নিয়ে সংগ্রাম করে, কিছু নায়িকা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মে, কিছু নায়িকা হেয়ালিতেই জীবন গড়ে নেয়। চরিত্রের মাঝে এই যে বৈচিত্র্য তারপরও কোথায় যেনো এক ধরনের হাহাকার তৈরি হয়।

"আমার ভাংগা ঘরে, ভাংগা বেড়া,ভাংগা চালার

ফাঁকে অবাক জোছনা ঢুইকা পরে,হাত নাড়িয়ে ডাকে"

 ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া না পাওয়ার জটিল সমীকরণে লেখক হুমায়ুন কখনই ইতি টানেন নাই।

গল্প পড়া শেষ হয়ে যেতো ২/৩ ঘন্টায় বড়োজোর কিন্তু তার আবেশ,তার ভালো লাগা বছরের পর বছর মনে ধারন করে একজন হুমায়ুন প্রেমিকা হয়ে ওঠার গল্প শুধু কোন একজন কিশোরীর/ তরুণীর নয়।

হুমায়ুন পড়ার সময় হুমায়ুনের নায়িকা প্রতিটি পাঠিকাই হয়ে উঠি আমরা।

ভালেবাসা হুমায়ুন এর সকল নায়িকাকে, সকল প্রেমিকাকে।

ব্যক্তি হুমায়ুনকে নিয়ে কথা বলতে অনেকেই ভালোবাসে।একটা সময় বিরক্ত হতাম।তাদের সাথে ঝগড়া করতাম।এখন বিরক্ত বা ঝগড়া কিছুই আসে না মনে।

এখন সত্যিটা জানি, বুঝি বলে।যারা হুমায়ুনকে নিয়ে, হুমায়ুন এর সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে আসে তাদের একটা কথাই বলি, ৪/৫ টা বই না।  

হুমায়ুন এর কমপক্ষে ১০০ টা বই পড়ে তার সম্পর্কে মতামত দিতে আসবেন।

লেখক হুমায়ুনকে ধারন করতে হয়। তার অসাধারণ লেখনির ক্ষমতাই তাঁকে  যুগে যুগে ধারণ করবে,তাঁকে নিয়ে  যাবে পাঠক থেকে পাঠকের হৃদয়ে।

ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা  হুমায়ুন আহমেদকে।

ভালোবাসি লেখক সাহেব।একজন পাঠিকা হয়ে আপনার সাহিত্যর মাঝেই আপনাকে খুঁজে বেড়াই,খুঁজে পাই।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Video