চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১
চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

সংস্কৃতি

বলবো তো বলবে কি বলছে

জ্যোতির্ময় নন্দী
প্রকাশিত : শনিবার, ২০২৩ ফেব্রুয়ারী ১৮, ০১:১৩ অপরাহ্ন

আজকে ইচ্ছে বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু বলবো। কিন্তু সেটা শুরু করছি একটা জনপ্রিয় হিন্দি গানের শুরুর কিছু পংক্তি দিয়ে। সত্তরের দশকের হিন্দি ছায়াছবি কসৌটির জন্যে গানটা লিখেছিলেন মালিক বর্মা, সুর করেছিলেন কল্যাণজি-আনন্দজি। গানটার সঙ্গে বাংলার একমাত্র সম্পর্ক হলো এটা গেয়েছেন একজন বাঙালি গায়ক-- কিশোরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। গানটার প্রথম অনুচ্ছেদের কথাগুলো হলো:

 

হাম বোলেগা তো বোলোগে কি বোলতা হ্যায়।

এক মেমসাব হ্যায়,

সাথ মেঁ এক সাব ভি হ্যায়।

মেমসাব সুন্দর সুন্দর হ্যায়

সাব ভি খুবসুরত হ্যায়

দোনোঁ পাস পাস হ্যাঁয়

বাত খাস খাস হ্যাঁয়

দুনিয়া চাহে কুছ ভি বোলে

হাম কুছ নহিঁ বোলেগা

শ্‌-শ্‌-শ্‌-শ্‌....

 

হাম বোলেগা তো বোলোগে কি বোলতা হ্যায়।

 

এর মানে বাঙালির বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না। তবুও একটু বাংলা করে দিচ্ছি--

 

আমি বলবো তো বলবে কি বলছে।

এক মেমসাব আছে, সাথে এক সাহেবও আছে।

মেমসাহেব সুন্দর সুন্দর আছে,

সাহেবও খুবসুরত আছে।

দুজন পাশে পাশে আছে,

দুজন ভালোবেসে আছে।

দুনিয়া চায় তো যা ইচ্ছে বলুক,

আমি কিছু বলবো না।

শ্‌-শ্‌-শ্‌-শ্‌....

আমি বলবো তো বলবে কি বলছে।

 

ভাষার মাসের শেষে এসে ভাষা নিয়ে কিছু বলতে তাই ভয় হচ্ছে। সত্য সবাই হয়তো সুস্পষ্ট দেখছেন, কিন্তু আমি বলতে গেলেই হয়তো বলবেন: ওই দেখো, ব্যাটা বলছে! আমাদের উত্তরবঙ্গের রাজশাহী এলাকার ভাষাতেও বলে: বুইলব ত বুইলবে কি বুইলছে!

 

হিন্দি কবিতা দিয়ে বাংলা ভাষা সম্পর্কে বলাটা শুরু করছি, কারণ আমার বর্তমান মনোভাবের প্রতিফলন ঘটাতে বাংলায় এমন লাগসই কিছু এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। বলার কথা কিন্তু অনেক। বলে বলে শেষ হওয়ার নয়। তবুও কিছু সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করি।

 

১.

প্রথমে বলবো পুরস্কার নিয়ে। তিনটে সরকারি পুরস্কার-- বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, আর স্বাধীনতা পদক-- এমন সব লোকজন পাচ্ছে, দেখে চোখ চড়কগাছ হয়ে যাচ্ছে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মান নিয়ে অভিযোগ বা নেতিবাচক বিস্ময় আগেও ছিলো। কিন্তু এখন তা চরমে উঠেছে। সামাজিক ও সংবাদ মাধ্যমগুলোর বদৌলতে বা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে এমন বহুজনকে পুরস্কার-পদক পেতে দেখেছি, যা দেখলে মনে হয়, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র সেই স্মরণীয় বাণীর ইচ্ছাকৃত বিরোধিতা করেই যেন অজ্ঞানী অযোগ্যকে আদর করার একটা হিড়িক পড়ে গেছে। এটা করে দেশকে কোন্ উন্নতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কে জানে!

 

সরকারি পুরস্কারদাতাদের অনুসরণে বেসরকারিরাও অযোগ্যদের পদকসেবা বা পদসেবা দেয়ার জন্যে আকুল হয়ে উঠেছেন বলে আশেপাশে কিছু দৃষ্টান্ত দেখে মনে হচ্ছে। এর পেছনে তৈলমর্দন ও নগদনারায়ণের গরম ভূমিকার বিস্তর গল্পও বাতাসে উড়ছে, যার সিংহভাগই সত্য বলে মনে হয়।

 

এখন এসব কথা বললাম বলে অনেকেই হয়তো বলে বসবেন, ব্যাটা পুরস্কার পায় নি বলেই এমন বলছে। তাদেরকে সবিনয়ে জানাই যে, পুরস্কারপ্রাপ্তরা অনেকে আমাকে গুরু বা ওস্তাদ বা বড়ভাই ডেকে সালাম-নমস্কার দেন। পুরস্কার না পাই, পাইয়েদের সালাম তো অঢেল পাই। কাজেই আমার দুঃখ করার কী আছে, বলুন!

 

২.

এবার কিছু বলতে চাই বাংলা একাডেমিকে নিয়ে। আমাদের মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা ও শুদ্ধতা রক্ষা, পরিপোষণ ও উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি গুরুদায়িত্ব এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির ওপরই ন্যস্ত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কাজকম্মো দেখে মনে হয়, ভাষার মর্যাদাহানি ও অশুদ্ধতা সৃষ্টি, অবনমন ও পরপোষণই তার লক্ষ্য। কিংবা হয়তো পরপোষণও নয়, নিজপোষণ। সরকারি বরাদ্দ ভাগজোক করে নিজেদের পকেটে পোরার-- মানে রক্তচোষা ছারপোকাদের-- একটা ভালো ঘাঁটি হয়ে উঠেছে এ প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে যেসব বই বা অভিধান বেরুচ্ছে, যেসব গবেষণাকর্ম বা অনুষ্ঠান হচ্ছে, যেসব পদক-পুরস্কার যাদেরকে দেয়া হচ্ছে-- বেশির ভাগই প্রশ্নবিদ্ধ, প্রশ্নসাপেক্ষ, নিন্দনীয়, কঠোরতম সমালোচনাযোগ্য। মোটামুটি পাইকারি হারেই এ মন্তব্য করা চলে বাংলা একাডেমি সম্পর্কে।

 

সত্যি বলতে কী, গু সব মাছই খায়, তবে দোষ হয় পাঙ্গাশের। বাংলা একাডেমির যেসব সদ্‌গুণসৎকর্মের কথা বললাম, এমনতরো কাজের কাজি আর আর গুণের গুণী তার ভগ্নীতুল্য অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানও। যেমন-- জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় শিশু একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানে কোনো কোনোটিতে পরিচালক হিসেবে সম্প্রতি আমার খুব কাছের বন্ধুদের কেউ-কেউও নিয়োগ পেয়েছেন। এঁদেরকে আমি ভালোমানুষ, সৎ মানুষ হিসেবেই জানি। কিন্তু যেসব পুরোনো ছারপোকাদের আড়তে তাঁরা গিয়ে ঢুকেছেন, সেখানে ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন বলে মনে হয় না, সে তাঁরা যতই পরিচালক হোন না কেন। আসল তেলেসমাতির পরী চালনা হবে অন্য জায়গা থেকে, পরিচালকদের জ্ঞানত বা অজান্তেই।

 

এখন হয়তো অনেকে বলবেন, আমি কোনো প্রতিষ্ঠানে পরী চালনার দায়িত্ব পাই নি বলেই ঈর্ষায় জর্জরিত হয়ে এমনটা বলছি। তাঁদেরকে বলতে চাই, ছারপোকাকে আমি খুবই ভয় পাই, জিনপরীর চেয়েও। এসব রক্তভোজী ছারপোকা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার চেয়ে ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে রক্তদান করা অনেক বেশি শ্রেয় বলে আমি মনে করি-- আন্তরিকভাবে।

 

৩.

তৃতীয়ত আমার কিছু কথা আছে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে। দিনটাকে আমরা ছোটবেলায় বলতাম শহিদ দিবস। তারপর এর নাম শোনা গেলো ভাষাশহিদ দিবস। তারপর ক্রমে ক্রমে শুধুই ভাষা দিবস। এখন আবার পদোন্নতি পেয়ে হয়েছে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘ ভাষার জন্যে বাঙালি জাতির আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করেছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে এখন দিবসটি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এটা বাঙালি জাতির জন্যে অবশ্যই অত্যন্ত গৌরবের কথা, শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাঙালি জাতিটা কোথায়? বাংলাদেশে না ভারতে? নাকি বিশ্বের অন্য কোথাও?

 

বাংলাদেশে ফরম ভরার সময় জাতীয়তার ঘরে কিছুদিন বাঙালি লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবৎকালে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নামেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতায় আগতরা সেই যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পত্তন করলো, এখনও খাতায় কলমে আমরা সেখানেই আছি। জাতি হিসেবে আমরা বাংলাদেশি। পড়শি ভারতে যেসব বাঙালি থাকে তারা জাতি হিসেবে ভারতীয়। সুতরাং বিশ্বে এ মুহূর্তে বাঙালি বলে কোনো জাতি নেই। কোনোকালে ছিলো বলেও মনে হয় না, শুধু ১৯৭১-এর পরেরকার কয়েকটি বছর বাদে। একটা মহাজাতির উত্থানের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো, কিন্তু তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হলো। সুতরাং যে-জাতির অফিসিয়াল কোনো স্বীকৃতি বা অস্তিত্বই নেই, তার আবার জাতীয় ভাষার জন্যে আত্মত্যাগ অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতোই ব্যাপার।

 

তবুও কিছু তরুণ যে ভাষার জন্যে আন্দোলন করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেছিলো, এবং ভাষাসূত্রে তারা যে বাঙালি ছিলো, এটা অকাট্য সত্য। ১৯৫২র ২১ ফেব্রুয়ারির ৯ বছর পর ১৯৬১র ৯ মে বাংলা ভাষার জন্যে শাহাদত বরণ করলো আরো ১২ জন বাঙালি (বাংলাভাষী অর্থে) স্বাধীন ভারতের শিলচরে। এসব আসলে বাংলা তথা বাঙালির চিরসংগ্রামী অস্তিত্বের মাইলফলক।

 

সত্যি বলতে কী, বাংলা ভাষাকে চিরকাল সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হয়েছে। রাজার বা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা এ ভাষা পায় নি বললেই চলে। বাংলার ঘরের সন্তান পালরা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যে-চারশ বছরের মতো টানা ক্ষমতায় ছিলো, তখনই সামান্য রাজানুকূল্য পেয়েছে তখনও নিতান্ত নবজাত, নবীন বাংলা ভাষা। তবুও তখন তার শক্ত প্রতিদ্বদ্বী ছিলো প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি প্রাকৃত ভাষা। তার মধ্যেই স্থানীয় মানুষের মুখের ভাষায় তখন সাধক শ্রমণরা রচনা করেছেন চর্যাচর্য বিনিশ্চয় বা চর্যাপদ-এর মতো মননশীল গ্রন্থ। হাজার বছরের প্রাচীন চর্যাপদের অন্যতম রচয়িতা ভুসুকপাদের লেখনীতেই পাওয়া গেছে বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রথম উচ্চারণ-- আজি ভুসুকু বঙ্গালি ভইলা..., আজকে ভুসুকু বাঙালি হলো।

 

এর পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় আটশ বছর ধরে চলেছে বাংলার দুয়োরানি মর্যাদার কাল। প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে কুঁড়েঘরে তার নির্বাসন। সুয়োরানির আসনে কোনো বিদেশি গরবিনী ভাষা, বাংলায় বিজয়ী জাতিরা যাকে সঙ্গে করে এনেছে। সেন শাসনামলে সংস্কৃত, সুলতানি আমলে তুর্কি, মোগল আমলে ফার্সি, ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি এদেশের রাজকীয় তথা রাষ্ট্রীয় মূল ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যতই প্রাসাদবাসিনী রাজপ্রিয়া হোক, সুয়োরানি চিরকাল বন্ধ্যাই থেকেছে বাংলার মাটিতে। শত চেষ্টাতেও কিছু গর্ভস্রাব বা অপোগণ্ড ছাড়া বিদেশি ভাষাগুলোতে এদেশে যথার্থ মানসম্পন্ন কোনো সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় নি বললেই চলে। না সংস্কৃতে, না ফার্সিতে, না ইংরেজিতে, না উর্দুতে। জয়দেবের মতো কবিকেও প্রাকৃতগন্ধী কবি আখ্যা নিয়ে উত্তর ভারতীয় বলয়ের পণ্ডিতদের সমালোচনা সহ্য করতে করতে হয়েছে।

 

বাংলায় কাব্য-সাহিত্য যা হয়েছে, তা ভালো হোক বা মন্দ, গ্রাম্য হোক বা নাগরিক, সব বাংলাতেই হয়েছে। বাংলাতেই এসেছেন বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, কাজি দৌলত, আলাওল হয়ে মধু-হেম-নবীন, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের মতো কবিরা।

 

বাঙালি ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি পড়েছে, চর্চা করেছে, কাজের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু বাংলার মাটিতে কোনো সাদি-খৈয়াম-হাফিজ, শেক্সপিয়র-মিল্টন-বায়রন-কিট্স্-শেলি বা গালিব-ইকবালের জন্ম হয় নি। সুয়োরানি বন্ধ্যাই থেকেছে। দুয়োরানির ঘরেই জন্ম নিয়েছে সাত ভাই চম্পা আর পারুল বোন। সুয়োরানির শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তারা বেঁচেবর্তে থেকেছে, পূর্ণ প্রস্ফূটিত হয়েছে। শেষপর্যন্ত বাংলার মাটি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে সুয়োরানিকে-- অর্থাৎ বিদেশি ভাষাকেই।

 

কিন্তু প্রায় হাজার বছর টানা পরজাতির শাসনাধীনে থাকা বাঙালি কি সুয়োরানিকে সত্যিই সম্পূর্ণ নির্বাসিত করতে পেরেছে? বিগত হাজার বছরের পরাধীনতার জোয়াল এখন তাদের ঘাড়ে না থাকলেও মনে মনে তারা বয়ে চলছে না তো! ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতো বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা সত্যিকারভাবে, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সও প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল হয়ে এলো। কিন্তু আজও বাংলা ভাষার এ দুর্দশা কেন? কিংবা আরো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে-- কেন এ ভাষার অবস্থা দিন দিন অধোগামী হচ্ছে? কেন আজো এদেশের অর্থনৈতিকভাবে প্রাগ্রসর জনগোষ্ঠী ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষামাধ্যমে লেখাপড়া করতে চায়? কেন আজও যেকোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্যে ইংরেজি বইয়ের দ্বারস্থ হয়ে থাকতে হয়? কেন এতদিনেও বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পাঠ্যবইগুলো বাংলায় অনুবাদের প্রকল্প হাতে নেয়া হলো না? কেন আজও বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অর্ধেক সংস্কৃত, আর বাকি অর্ধেক ইংরেজি ব্যাকরণের অনুকরণ? কেন আজও একটা সত্যিকারের বাংলা ব্যাকরণ লেখা হলো না? এসব ব্যাপারে সরকারের বা বাংলা একাডেমির ভূমিকা কী এবং কতটুকু?

 

ফেব্রুয়ারি মাস বা তার একুশ তারিখটাকে আমার শোকের মাস বা দিনের চেয়ে সুখের মাস বা দিন বলেই বেশি মনে হয়। সময়টাও ফাল্গুন মাস-- বসন্ত কাল। বইমেলায়, আড্ডায়, পানে-ভোজনে, সঙ্গসাহচর্যে জমজমাট একটা সময়! মেলায় বইয়ের পাহাড় জমে ওঠে। সেইসাথে বেড়ে ওঠে ভুলের স্তূপ। তুষ বাছতে বাছতে পাঠকের বেলা যায়। দানার দেখা মেলে কদাচিত। ভাষাকে নিয়ে যতটা আবেগ দেখি, বেগ তার সিকিভাগও দেখি না। বইমেলার শিয়রে বসে ঝিমায় ভাষার অভিভাবিকা বাংলা একাডেমি। লাউডস্পিকারে ঘুরে ঘুরে বাজতে থাকে-- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... রক্তে রাঙানো...। পাদপ্রদীপের নিচে কাঁচভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়ে কোনো লাস্যময়ী কাব্যপ্রেমী বা কবিপ্রেমী তরুণী। রঙ লাগে কবির মদ্য বা গঞ্জিকারক্তিম চোখে।

 

হালকা চালের বাকতাল্লা বন্ধ করে, সবশেষে দুটো সত্যিকারের কাজের কথা বলি। বাংলা ভাষার দেহ, অর্থাৎ শব্দবিদ্যা বা ধ্বন্যাক্ষর গেঁথে শব্দ বানানো বা শব্দ গাঁথার নিয়ম সিণ্ট্যাক্টিক্স, এবং আত্মা, অর্থাৎ শব্দার্থতত্ত্ব বা শব্দের ভিতর থেকে অর্থ বের করার নিয়ম সেম্যাণ্টিক্স-- এ দুইয়ের সমন্বিত চর্চা করা না গেলে শুধু ঠেকা দিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে কতদিন সশরীরে, সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে, সে-ব্যাপারে গভীর সন্দেহের অবকাশ আছে। শুধু আবেগ বা তথাকথিত রোম্যান্টিক ভালোবাসা নয়, দায়িত্বশীল ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত স্তরের উচ্চশিক্ষার বাহন হিসাবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। উচ্চভাব বা ভাবনার বাহন হিসেবে বাংলাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাভাষার অতুল ঐশ্বর্যের অনন্যতাকে উপলব্ধি ও আত্মস্থ করতে হবে। বাংলা ভাষিক অস্তিত্বকে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অবিচলভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে।

 

প্রতিটি শিশুর অন্তরে গোড়াতেই বুনে দিতে হবে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি নিঃশর্ত শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বীজ। সে-বীজকে মহীরুহ করে তোলার দায়িত্বও দেশের সরকারের, একাডেমির, আপনার, আমার সকলের। এই গুরুদায়িত্ব যদি আমরা আজও, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় এসেও যদি ঠিকমতো পালন করতে না পারি, তবে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন অর্থহীন ও আত্মপ্রবঞ্চনার সমার্থক হতে বাধ্য-- তা সে যতই ভাষা দিবস বা বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হোক না কেন।

 

তো, অনেক কথা বলে ফেললুম-- যদিও সব বিস্তারিত গুছিয়ে বলা গেলো না। এখন আপনারা চাইলে ঘুরে ঘুরে গাইতে পারেন-- বোলতা হ্যায়... বোলতা হ্যায়...! যতই বলুন, হিন্দি গান তো আপনারা সবাই খুব ভালোবাসেন, এমনকি বাংলা গানের চেয়েও--এই ভাষার মাসে, এই মাতৃভাষা দিবসেও! কয়লা সহজে কি ময়লা ছাড়ে!!!!

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Video