বাংলাদেশে এবারের ঈদের মাসে মুক্তি পাওয়া তিনটি সিনেমা- পরাণ, হাওয়া আর দিন দ্য ডে নিয়ে দর্শক আগ্রহ বেড়েই চলেছে । সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হলগুলোতে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক ভিড় । তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত হল না থাকার কারণে সিনেমাগুলো নিয়ে আগ্রহ মূলত ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, নির্মাতা ও দর্শকরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই
বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ দেখা গেছে, কিন্তু পরে
তা ধারাবাহিকভাবে ঘটতে দেখা যায়নি। তাঁরা মনে করছেন, এবার একসাথে তিনটি ছবি
মুক্তি পাওয়াতেই দর্শকের আগ্রহটা আবার ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে ।
এর মধ্যে বড় বাজেটের ছবি হিসেবে আলোচিত ‘দিন
দ্য ডে’ সিনেমাটির চাহিদা কিছুটা কমলেও, ‘পরাণ’
ও ‘হাওয়া’-কে নিয়ে দর্শকদের মধ্যে অব্যাহত আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু এ তিনটি ছবিই বাংলাদেশি সিনেমার কথিত সুদিন-- অর্থাৎ
হল-ভর্তি দর্শক কিংবা টিকেটের জন্য কাড়াকাড়ি-- এমন দৃশ্য দেখার মতো পরিস্থিতি
তৈরি করবে কিনা, তা বলা কঠিন বলেই মনে করছেন তাঁরা।
কারণ হিসেবে এই চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মানসম্মত সিনেমা
হলের সংখ্যাই আছে হাতে গোনা কয়েকটি। আবার বিনিয়োগ সংকটের পাশাপাশি সিনেমার গল্প
তৈরিতেও আছে নানা ধরণের বাধা-বিপত্তি।
‘টিকেট
পেতে কষ্ট হয়েছে’
এবার ঢাকার একটি সিনেপ্লেক্সে দল বেঁধে বন্ধুদের সাথে তিনটি
সিনেমাই দেখেছেন ফাবিহা রহমান।
তিনি বলছেন, আলোচিত তিনটি ছবিতে বিনোদনের সব উপাদান যেমন আছে তেমনি
গল্পও ভালো।
“ভালো
লেগেছে। দুটির টিকেট পেতে কষ্টই হয়েছে। তবে বাংলা সিনেমা নিয়ে ভয় কেটে গেছে
বলতে পারেন। আবার ছবি বানানোর মানও এখন অনেক ভালো হয়েছে,”
বলছিলেন তিনি।
অন্যদিকে বেসরকারি চাকুরিজীবী নিশীথা ইসলাম বলেছেন, হলগুলো ভালো
হলে আর সিনেমা মোটামুটি হলেও নিয়মিতই সিনেমা দেখবেন তিনি।
“পরিবেশটা
ভালো পেলে তো রেগুলার হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। এবার দুটি দেখলাম একই দিনে,”
বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, পরাণ, হাওয়া আর দিন দ্য ডে-- তিনটি সিনেমাই চলচ্চিত্র
রিলিজের যে প্রথাগত ধাপগুলো অর্থাৎ পোস্টার, ট্রেলার এবং পরে রিলিজ-- সব ধাপেই
ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সিনেমাগুলো দেখতে সিনেপ্লেক্স ও
মাল্টিপ্লেক্স ছাড়াও সিনেমা হলগুলোতে ভিড় করছে মানুষ।
এমনকি অনেক বছর পর এবার এই তিনটি বাংলাদেশি সিনেমারই অগ্রিম টিকেট
কিনতে দেখা গেছে দর্শকদের।
ঢাকার প্রচলিত ধারার সিনেমা হলগুলোর অনলাইনে টিকেট বিক্রির সুযোগ
না থাকায় ঢাকার মধুমিতাসহ কয়েকটি হলের কাউন্টার থেকেই অগ্রিম টিকেট সংগ্রহ
করেছেন দর্শকরা।
মধুমিতা হল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরাণ ও হাওয়া সিনেমা দুটির মাধ্যমে
তারা আবার নাইট শো চালু করেছে-- যা দর্শকের অভাবে প্রায়শই বন্ধ রাখতে হতো।
অন্যদিকে পরাণ প্রথম সপ্তাহে এগারটি হলে মুক্তি পেলেও তৃতীয়
সপ্তাহ নাগাদ ৬০টি হলে একযোগে চলেছে।
অন্যদিকে হাওয়া এখন সবধরণের হলেই চলছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। ঢাকার
পাঁচটি সিনেপ্লেক্সের একাধিক হলে হাওয়া প্রদর্শন করা হচ্ছে ঈদে মুক্তির পর থেকেই।
এখনো দর্শকদের কাউন্টার বা অনলাইন থেকে কয়েকদিন পরে দেখার জন্য টিকেট কিনতে হচেছ।
একসাথে একাধিক বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যায়নি।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি সুদিনের ইঙ্গিত?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের
অধ্যাপক ড. এ. জে. এম. শফিউল আলম ভুঁইয়া বলছেন, এ তিনটি সিনেমাকে ঘিরে যা হলো, তাতে
সিনেমার ভালো সময়ের লক্ষণ পরিষ্কার; কিন্তু সেটি টেকসই করার জন্য দরকার নিয়মিত
ভালো সিনেমা আর দেশ জুড়ে মানসম্মত সিনেমা হল।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই এমন কিছু সিনেমা আসছে যা
দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে । কিন্তু এরকম ছবির মুক্তি পাওয়াটা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে না
বলে কিছুদিন পরেই সিনেপ্লেক্সগুলোতে দেখানো ইংরেজি বা হিন্দি সিনেমাগুলোতে আবার
আলোচনায় চলে আসে।
শফিউল আলম ভুঁইয়া বলেন, এবার যে ছবিগুলো এসেছে এগুলো এফডিসি
ঘরানার বাইরের মুভি। কিন্তু এগুলো প্রমাণ করেছে যে মোটামুটি দেখার মতো মুভি হলেই
মানুষ হলে আসবে। কারণ বিনোদনের আর কোনো মাধ্যম এদেশে নেই।
“গত
কয়েক বছর ধরেই কিছু কিছু সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছিলো। কিন্তু রেগুলার সিনেমা
আসছে না। এবার একসাথে তিনটি রিলিজ হয়েছে। এখন সব সিনেমাই চলবে তা নয়, তবে
লক্ষণটা ভালো। কারণ নতুন উচ্চশিক্ষিত তরুণ নির্মাতারা আসছে। কিন্তু সিনেমার সংখ্যা
আরও বাড়াতে হবে। মাঝে মধ্যে এমন দু-তিনটা সিনেমা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে না,”
বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, এফডিসি-কেন্দ্রিক যেসব বাংলাদেশি সিনেমা মাঝেমধ্যে
মুক্তি পায় সেগুলো সাধারণ সিনেমা হলগুলোতে চললেও তাতে খুব একটা দর্শক দেখা যায়
না।
চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক অনুপম হায়াত বলছেন, দেশে এখন সিনেমা হলের
সংখ্যাই হাতে গোনা এবং সেগুলোর আবার পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন আছে।
“তবে
এ তিনটি সিনেমা একটি আশাব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি করেছে বাংলা সিনেমার জন্য। মানুষ যে
মুখিয়ে আছে ভালো বাংলা সিনেমার জন্য সেটিই আবার প্রমাণ হলো। কিন্তু সব স্তরের
মানুষকে আবার হলমুখো করতে আরো অনেককিছু করতে হবে,” বলেন তিনি।
মোবাইলে ইন্টারনেটের মান আরও খারাপ হবার আশঙ্কা কেন
সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে কোন দেশ কী করছে
প্রযোজক পরিচালকদের আগ্রহী করবে
বাংলাদেশে এর আগে আয়নাবাজি, দেবি, ঢাকা অ্যাটাক, মনপুরা কিংবা
স্বপ্নজালের মতো কিছু সিনেমা গত কয়েক বছরে বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
তবে এগুলো আলাদা আলাদা সময়ে মুক্তি পেয়েছিলো এবং এর পরের অন্য
মুভিগুলোর ক্ষেত্রে দর্শকদের ততটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এসব সিনেমার
প্রযোজক-পরিচালকরাও নিয়মিত নতুন সিনেমা নিয়ে আসেননি।
চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলছেন, ভালো সিনেমা পেলে
মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখে-- এটি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করবে নতুন বিনিয়োগের
জন্য।
তবে সিনেমার গল্প, নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি প্রমোশন বা মার্কেটিং যে
কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও এ তিনটি ছবি প্রমাণ করেছে বলে মনে করেন তিনি।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “আমার নিজের সিনেমা ‘পাপ
পুণ্য’ হলে মানুষ দেখেনি প্রচার না হওয়ার কারণে। অথচ ইউটিউবে ৮২ লাখ বার
দেখা হয়েছে সিনেমাটি এবং রিভিউ খুব ভালো। এবার হাওয়া মুভির প্রমোশন হয়েছে
অসাধারণ। ভালো সিনেমাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।”
তাঁর সঙ্গে একমত শফিউল আলম ভুঁইয়াও। তাঁর মতে হাওয়া ছবিটির
প্রমোশন নির্মাতাদের চোখ খুলে দিয়েছে এবং দর্শকরাও সেটি গ্রহণ করেছে।
প্রযোজক পরিচালকরা জেনেছেন কেমন সিনেমা মানুষ দেখবে
তরুণ নির্মাতা আশফাক নিপুণ বলেছেন, “অনেক বছর পর এবার মানুষ
হলে গিয়ে সেলিব্রেট করে সিনেমা দেখলো। কিন্তু এখন যদি সবাই মনে করে যে প্রতি
মাসেই এমন সিনেমা আসবে, সেটা ঠিক হবে না।”
হাওয়া, পরাণ ও দিন দ্যা ডে-- তিনটিই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তৈরি করা
সিনেমা। তবে এর মধ্যে দুটি ঈদের আর একটি তার কয়েকদিন পরে মুক্তি পেয়েছে।
যেখানে অনেক বছর ধরেই বাংলা সিনেমা দর্শক সংকটের কারণে হলগুলো বন্ধ
হয়ে যাচ্ছিলো সেখানে এবার এত আগ্রহ কিংবা টিকেটের জন্য এমন হাহাকারের মাধ্যমে
প্রযোজক ও পরিচালকরাও জেনেছেন যে মানুষ কেমন ছবি দেখতে চায়, বলছিলেন আশফাক নিপুণ।
তিনি বলেন, “এ তিনটা ছবি মানুষ এমন সময় দেখছে যখন মানুষ অর্থনৈতিক সংকটের
মুখোমুখি বা তেমন আশঙ্কার মধ্যে আছে। এটা প্রমাণ করেছে বিনোদনের জন্য সিনেমা এখনো
কতটা পাওয়ারফুল। ঠিকভাবে সততার সঙ্গে সিনেমা তৈরি হলে ও এর প্রচার ঠিক মতো হলে
মানুষ আবার হলে ফিরে আসবে।”
তাঁর মতে, বড় পর্দার বিনোদন অনেক দিন ধরেই মানুষ পাচ্ছিল না। এখন
এ তিনটি সিনেমার সাফল্য লগ্নিকারকদের মধ্যেও আগ্রহ তৈরি করবে।
“এখন
বিনিয়োগের সাহস বাড়বে। নির্মাণের সাহস বাড়বে। এতদিন প্রযোজক ও ডিস্ট্রিবিউটররা
লাভ পেতোনা বলে বিনিয়োগ করতোনা। এখন সেটি হয়তো পাল্টাবে। আবার পরাণ ও হাওয়া
কিন্তু নতুনদের নিয়ে তৈরি করা। ফলে নতুন শিল্পী ও গল্পেও বিনিয়োগ আসবে,”
বলেন তিনি।
আমাকে সুস্থ জীবন যাপন করতে দিন, বলছেন পরীমনি
পরীমনিকে 'যৌন আক্রমণ ও হত্যাচেষ্টার' অভিযোগে গ্রেফতারদের মাদক
মামলায় রিমান্ড
‘সুদিন’ ফেরানোর
পথে বাধা অনেক
নাম প্রকাশ করতে চাননি এমন একজন নির্মাতা বলছেন, বাংলাদেশি
সিনেমাকে আবার জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে অনেক বাধা আছে, যেগুলো দূর না করলে
মাঝেমধ্যে এমন কিছু ছবি ভালো করবে, কিন্তু দিনশেষে তা বাংলাদেশি সিনেমা
ইন্ডাস্ট্রিতে দর্শককে আগের মতো করে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি সিনেমার বিপরীতে মানুষ হলিউড-বলিউডের মুভি
দেখে। কিন্তু এখানে নাচ-গানে তো বাধা আছেই, এমনকি অনেক গল্পও সেন্সর বোর্ড অনুমোদন
দেয় না।
“ভারতে
আর্মি ও পুলিশ নিয়ে কত ধরণের সিনেমা! পুলিশের কত ধরনের চরিত্র! কিন্তু এখানে
সিনেমায় পুলিশ চরিত্রের ইউনিফর্মে ব্যাজ কোন কর্মকর্তার, তা নিয়ে নির্মাতাদের
হেনস্থা করা হয়। অনেক ভালো গল্প নিয়ে নির্মাতারা এগুনোর সাহস পান না এসব কারণে,”
বলছিলেন তিনি।
আবার ভারতে তাজ হোটেলে হামলা নিয়ে সিনেমা হলেও বাংলাদেশে হলি
আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে নির্মাণ করা সিনেমা আটকে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড।
অন্যদিকে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স ছাড়া দেশের সিনেমা দেখার
মতো ভালো পরিবেশ আছে এমন সিনেমা হল নেই বললেই চলে।
দেশজুড়ে এখন মাত্র ৫০/৬০টি প্রচলিত ধারার সিনেমা হল এখন চলমান
আছে। আর সব হল ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে দর্শক শূন্যতা ও অশ্লীলতার কারণে।
ঢাকায় এসে এবার সিনেমা দেখেছেন খুলনা ফওজিয়া আক্তার। অথচ তিনি
নাকি গত এক দশকে কোনো সিনেমা হলে যাওয়ার সাহসই পাননি।
তিনি বলেন, “সিনেপ্লেক্স বলে ঢাকায় আসলে মুভি দেখি। ছোটবেলায় হলে গিয়ে
দেখতাম। মাঝে এমন পরিবেশ হয়েছিলো যে হলের সামনে দিয়ে যেতেও অস্বস্তি হতো। আর এখন
তো বন্ধই হয়ে গেছে হলগুলো।”
অনুপম হায়াত অবশ্য বলছেন, সরকার প্রতি উপজেলায় সিনেপ্লেক্স তৈরির
যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি হলে আর বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এলে বাংলাদেশি
সিনেমা আবার যে দর্শক পাবে, এবারের আলোচিত তিনটি সিনেমাই তার প্রমাণ।-- সূত্র:
বিবিসি
মন্তব্য করুন