চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প নেয়া হয় পাঁচ বছর আগে। যথাযথ সমীক্ষা ছাড়াই কাজ শুরু করায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় দুই দফায়। বর্তমানে প্রকল্পটির দুই-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হলেও জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো আভাসই দেখা যাচ্ছে না চলতি বর্ষা মৌসুমে। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের সুফল নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্ব বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে।
চসিকের
দাবি, জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এতে চসিকের কোনো দায় নেই। অন্যদিকে
সিডিএ মনে করছে, মেগা এ সিটির কিছু বিলুপ্ত ও দখল হয়ে যাওয়া খাল ও নালা উদ্ধার করে
সংস্কারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। চট্টগ্রাম শহরে প্রকল্পের বাইরে অন্তত ১০
গুণ নালা ও খাল রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও চসিকের আওতাধীন বাকি নালা ও খাল যথাযথভাবে
সংস্কার ও দখলমুক্ত না থাকায় জলাবদ্ধতার সংকট কাটছে না। এজন্য চসিককে দায়িত্ব দিতে
হবে বলে মনে করছে সিডিএ। যদিও চসিকের অভিযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে চসিকের বিভিন্ন প্রস্তাব
ও সুপারিশ আমলে না নেয়ায় জলাবদ্ধতা সংকটের জন্য সিডিএ সরাসরি দায়ী।
গত
কয়েকদিনের টানা বর্ষণে পানিতে ডুবে গেছে নগরীর বেশির ভাগ এলাকা। আগে যেখানে হাঁটুসমান
পানি উঠত এবার সেখানে পানি উঠেছে কোমরের ওপরে। এমনকি নগরীর বেশ কয়েকটি জায়গায় নৌকায়
চলাচল করতেও বাধ্য হয়েছে নগরবাসী। প্রকল্পের কাজের অপরিকল্পনার কারণে গত বছর ড্রেনে
পড়ে প্রাণ হারায় চারজন। আহত হন আরো অন্তত ১০ জন। মূলত জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজের সময়
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকা এবং প্রচণ্ড বর্ষণের কারণে তৈরি স্রোতে ভেসে তারা নিহত
হয়।
চট্টগ্রাম
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা
হয় ২০১৭ সালে। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।
তবে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
নতুন করে কাজের ক্ষেত্রে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নের কাজ চলমান
থাকায় প্রকল্পের কাজ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে বাস্তবায়নকারী
সংস্থা। এ প্রকল্পে সিডিএ ১ হাজার ৭৪৪ কোটি ৮৯ লাখ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বরাদ্দ
দেয়া হয়েছিল ৩ হাজার ৮৪৩ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য
জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ৬ হাজার ৫১৬ কাঠা, রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে ৮৬ দশমিক ৬৮ কিমি,
খাল খনন করা হচ্ছে ৯৭ দশমিক ৭০ কিমি, কালভার্ট ও পিসি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে ৫৪টি এবং
রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে ১৭৬ কিমি।
সর্বশেষ
তথ্যমতে, চসিকের আওতাধীন ৩৬টি খালের ময়লা এবং কাদামাটি অপসারণ করা হচ্ছে। যার কারণে
এ খালগুলোর ওপরে গড়ে ওঠা সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভারী স্থাপনা অপসারণ করেছে প্রকল্প
বাস্তবায়নকারী সংস্থা। মোট ২৮টি খালের পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণকাজ চলছে। প্রকল্পে
মোট ১৭৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৯০ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল দৃশ্যমান হয়েছে, বাকি
অংশের কাজ চলমান আছে। এছাড়া ৫৪টি কালভার্ট, ১০ কিমি নতুন ড্রেন নির্মাণ, সাড়ে ১৫ কিমি
রোড সাইড ড্রেন নির্মাণ করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে জলাবদ্ধতা প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ
কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব না হওয়ায় বেশকিছু জায়গায় এখনো সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
নতুন
সংশোধিত প্রকল্পে সিডিএ ১০ হাজার ৪২০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে ডিপিপি তৈরি করেছিল।
কিন্তু গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ব্যয়ের যৌক্তিকতা নির্ণয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন
করে। কমিটি চার দফা বৈঠক করে প্রকল্প ব্যয় ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। সংশ্লিষ্ট
নথি বলছে, প্রতিরোধ দেয়াল, নালা নির্মাণ, ব্রিজ-কালভার্ট, টাইডাল রেগুলেটর, সিল্ট ট্র্যাপের
মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নকশায় গলদ রয়েছে। চট্টগ্রামের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
করতে মূল ডিপিপিতে নির্ধারিত নকশার বেশ পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ কারণে
নির্মাণ ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের
নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়ও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটি ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
না করে প্রস্তাবের বিষয়টি উঠে এসেছিল। এর পরও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের স্বার্থে
তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।
নগরীর
২২টি এলাকাকে গুরুত্ব দিয়ে জলাবদ্ধতা প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এলাকাগুলোর মধ্যে
অন্যতম চকবাজার, প্রবর্তক মোড়, ২ নং গেট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই,
আগ্রাবাদ, হালিশহর ইত্যাদি।
প্রকল্প
কাজ শেষ হতে দেরি হওয়া প্রসঙ্গে সিডিএর কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের কাজ মূলত খাল
ও ড্রেনভিত্তিক হওয়ায় বর্ষা মৌসুমের পুরোটাই বন্ধ রাখতে হয়। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
কাজ একেবারেই ধীর হয়ে যায়, যার কারণে বর্ষা মৌসুমে আমাদের কাজের রক্ষণাবেক্ষণ করতে
হয়। অন্যদিকে প্রকল্পে নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ সার্ভে ও সমীক্ষা কাজ
২০১৯ সালের মার্চে শুরু করে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা সমাধানের জন্য একটি
পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সেখানে ডিপিপির ডিজাইনে দেয়া বিভিন্ন অংশের রিটেইনিং
ওয়াল, ব্রিজ-কালভার্ট, টাইডাল রেগুলেটর, সিল্ট-ট্র্যাপসহ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও চট্টগ্রামের পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে সমন্বয়পূর্ণ করতে ডিপিপি
নির্ধারিত ডিজাইনের বেশ পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। এছাড়া বিভিন্ন অংশের জন্য নতুন ডিজাইন
পাঠানো হলে প্রকল্প কাজের পরিবর্তন হয়। যার কারণে নতুন যুগোপযোগী ডিজাইনে কাজ করতে
গিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে গিয়েছে বলে জানান তারা।
চট্টগ্রামের
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন,
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সিংহভাগই বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। যথাসময়ে ও সুষ্ঠুভাবে
প্রকল্প কাজ করতে না পারা ও চসিকের সঙ্গে সংকট মোকাবেলায় সমন্বয়হীনতায় এসব কাজের সুফলবঞ্চিত
হচ্ছে নগরবাসী। আমরা চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন ও দখল হওয়া বিভিন্ন খাল উদ্ধারের
প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু এসব বিষয়ে সিডিএ কোনো সহযোগিতা করছে না। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনের
কাজগুলোর সুফল ক্রমেই বিলম্বিত হচ্ছে।
যদিও
সিডিএ বলছে ভিন্ন কথা, জলাবদ্ধতা নিরসন সিডিএর কাজ নয়। এর পরও প্রকল্পটি নেয়া হলে তড়িঘড়ি
করে বাস্তবায়নের প্রয়োজনে করা সমীক্ষায় কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। এজন্য প্রকল্পটি সংশোধন
করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের শতাধিক খাল, ছোট, মাঝারি ও বড়
নালা সমন্বিতভাবে ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটারের বেশি। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীন মাত্র
৩১৩ কিলোমিটার নালা ও ৯৮ কিলোমিটার খাল খনন করা হচ্ছে। বাকি নালাগুলোর কাজ যদি চসিক
করতে না পারে, তবে প্রকল্পের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। প্রাইমারি নালাগুলো দিয়ে পানি
যদি বৃহৎ খাল ও নালায় যেতে না পারে, তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরও জলাবদ্ধতা সংকট
কাটবে না।
সিডিএর
প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক কাজী হাসান বিন শামস বণিক বার্তাকে বলেন, জলাবদ্ধতা
নিরসনের প্রকল্পটির কাজ চলমান। প্রকল্পের দুই-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হলেও আরো বেশি সুফল
পেতে ডিপিপিতে সংশোধন আনা হয়েছে। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন সিডিএর কাজ নয়। চট্টগ্রামের
অধিকাংশ নালা আবর্জনার কারণে কার্যত অকার্যকর। ছোট নালাগুলো দিয়ে পানি মাঝারি ও বড়
নালায় যেতে পারে না। এসব সমস্যা সমাধান করতে না পারলে বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও
সুফল মিলবে না। চসিকের উচিত তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নগরীর
ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো।
চট্টগ্রামের
জলাবদ্ধতা প্রকল্পের ব্যয় কেন এত বাড়ল এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ
বড়ুয়া বলেছেন, চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা প্রকল্পটির শুরুতে কোনো সমীক্ষা
কিংবা যুগোপযোগী নকশা ছাড়াই কাজ শুরু করা হয়েছে। যার কারণে ২০১৭ সালে প্রকল্প শুরু
হলেও দু-তিন বছর পর নতুন নকশায় কাজ শুরু হয়। তাড়াহুড়ো করে সম্ভাব্যতা যাচাই, নিরীক্ষণ
ও কর্মপরিকল্পনার অভাব, সময়মতো কাজ শুরু না করার কারণে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়েছে। মূলত
যেকোনো বড় প্রকল্প শুরুর আগে সঠিকভাবে মাঠের কাজ কয়েক দফায় বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
নিতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ফিল্ড ওয়ার্ক তেমন করা হয় না। যার কারণে প্রকল্পগুলো কতটা
কার্যকর হবে সেটা সময়ই বলে দেবে।-- সৌজন্যে: বণিক বার্তা
মন্তব্য করুন