চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সাফল্য

মো. ফখরুল ইসলাম

জীবনযুদ্ধে জয়ীদের সাফ শ্রেষ্ঠত্বের হাসি


প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২০২২ সেপ্টেম্বর ২০, ০৯:১৩ পূর্বাহ্ন
সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২-এ বিজয়ী বাংলাদেশ দল।

বাংলাদেশের ফুটবল তথা ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটা দিন হয়ে থাকল সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর)। এদিন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ দেশের ১৬ কোটি মানুষকে উৎসবের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন নারী ফুটবলাররা। সাফ উইমেনস চ্যাম্পিয়নশিপের ২২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নিয়েছে লাল-সবুজের দল। দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব এখন অদম্য সাবিনা-মারিয়া ও সানজিদাদের। অবিস্মরণীয় এ অর্জনের পথে অবশ্য বন্ধুর এক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে নারী ফুটবলারদের।

চ্যাম্পিয়ন এই দলটার অনেকে এই পর্যন্ত এসেছেন বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে কিংবা কেউ আবার পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। যেমনটা ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছিলেন ফুটবলার সানজিদা আক্তারও। লিখেছেন, পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আছে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। জীবনের পরতে পরতে নানা বাধার শেকল ভেঙে আজ সাফল্যের চূড়ায় তারা।

২০০৪ সালে বয়সভিত্তিক ফুটবল দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পা ফেলার পর গেল কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পেয়ে আসছিল নারী ফুটবল দল। এ ছাড়া বয়সভিত্তিক সাফে শিরোপা জয়টাকে একরকম ডালভাত বানিয়ে ফেলেছিল এ দেশের কিশোরীরা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৫ সাফের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশের স্বর্ণকিশোরীরা। তাদের সেই সাফল্যের শুরুটা বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন দিগন্তের সূচনা এনে দিয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে ভুটানে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ নারী সাফেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। সবশেষ ২০২১ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় বাংলাদেশের বিজয়ের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করে।

তবে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ভালো খেললেও জাতীয় দলে তেমন আশাজাগানিয়া ফল আসছিল না। ২০১৬ সালে সাফ শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়েও স্বপ্নভঙ্গ হয়। ভারতের কাছে হারতে হয়। তবে সাবিনাদের আত্মবিশ্বাসটা বাড়ে গেল জুনে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রীতি সিরিজ জয়ের পর। র‌্যাঙ্কিংয়ে ৬১ ধাপ এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়াকে হেলায় হারিয়ে দেয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আগে এ সাফল্যটাই টনিকের মতো কাজ করল।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়েও কী দুর্দান্ত একটা টুর্নামেন্ট খেলল বাংলাদেশ। একটা পরিসংখ্যান দিলে তা স্পষ্ট হবে। নেপালে অনুষ্ঠিত সাফের ষষ্ঠ আসরের ফাইনালে স্বাগতিকদের ৩-১ গোলে হারানোর আগে গ্রুপপর্বে মালদ্বীপকে ৩-০, পাকিস্তানকে ৬-০, ভারতকে ৩-০ এবং সেমিফাইনালে ভুটানকে ৮-০ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন চ্যাম্পিয়নরা গোটা টুর্নামেন্টেই থেকেছে অপরাজিত। আরেকটা চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, গোটা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ গোল দিয়েছে ২৩টি। বিপরীতে খেয়েছে মোটে একটি।

বাংলাদেশের মেয়েদের দাপুটে এমন সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়েই মূলত আয়োজিত হয় এ টুর্নামেন্ট। একেবারে শৈশব থেকেই মেয়েদের পায়ে ফুটবল তুলে দেয়ার সেই তো শুরু। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে ছেলেদের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। মেয়েদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের যাত্রা তার পরের বছর। এই টুর্নামেন্ট দিয়েই প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক নারী ফুটবলার উঠে আসছে।

দেশের ফুটবলের উন্নয়নে বাফুফে (বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন)র সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নারী ফুটবল নিয়ে কেউ অন্তত তেমন প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। নারী ফুটবলারদের এই দুর্বার জয়যাত্রার পেছনে লেপ্টে আছে বাফুফের অনেক দিনের সাধনা এবং খেলোয়াড়দের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, যার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিলেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এবং বাফুফের নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরন। এ ছাড়া গোলাম রব্বানী ছোটন সেই ২০০৮ সাল থেকেই নারী ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। এ তিনজনের ঐকান্তিক চেষ্টা আর হার না মানা পরিশ্রমের ফসল আজকের চ্যাম্পিয়নরা।

কিশোরী ফুটবলারদের মতিঝিলের বাফুফে ভবনের চারতলায় রেখে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে এক প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। যদিও খুদে এ ফুটবলারদের প্রশিক্ষণের কাজটা অত সহজ ছিল না। তাদের খাবারের খরচ, পোশাকের খরচ, প্রশিক্ষণের খরচ, পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য প্রথম দিকে কোনো স্পন্সর পর্যন্ত ছিল না। বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন আর মাহফুজা আক্তার কিরন নিজেদের টাকা থেকে এ ব্যয় নির্বাহ করতেন। যদিও বছর তিনেক পর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ঢাকা ব্যাংক আর ইউনিসেফ।

দেশের ফুটবলে মেয়েদের এমন সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলার কলসিন্দুর বিদ্যালয়ের। এই এক স্কুল থেকেই প্রায় ১২-১৩ জন খেলোয়াড় খেলছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে। এ ছাড়া প্রতিবছরই নতুন করে আরও অনেকে যুক্ত হচ্ছেন। যেন নারী ফুটবলার তৈরির আস্ত কারখানা।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, একটা গ্রাম থেকে, একটা স্কুল থেকে বছরের পর বছর এত নারী ফুটবলার উঠে আসছে কীভাবে! তাদের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক মফিজ স্যারের হাত ধরে উত্থান হয় এই মেয়েদের। প্রথমে ২০০৯ সালে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা ফজিলাতুন নেছা কাপের জন্য দল গঠন করে। যদিও প্রথম দুই বছর তারা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। পরে আরো কঠোর পরিশ্রম আর অনুশীলনের মাধ্যমে তারা জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে।

ওই মেয়েরা বড় হয়ে কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ে যায়। তারপর একে একে যোগ দেয় জাতীয় দলে। অথচ ওদের প্রায় সবারই অভাবের সংসার। কারো মা রাস্তায় কাজ করেন, কারো বাবা রিকশা চালান। কারো-বা আবার শ্রমজীবী পরিবার। সে সময় যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হতো, তারা কী চায়, উত্তর পাওয়া যেত, পেট ভরে খেতে চাই। বেশি করে খাবার দিয়ে দিন, বাড়িতে সবাই মিলে খাব। খাবারের কষ্টে ফুটবল খেলা শুরু করা অদম্য মেয়েরা এখন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্রকে আরও গর্বিত করছে।

একজন ফুটবলারের সংগ্রামের গল্প শোনা যাক চলুন। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার এক অজপাড়া গ্রাম মন্দিরঘোনা। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামটিতে যেতে হলে নৌকাই একমাত্র বাহন। শুকনো মৌসুমেও নেতাই নামক খরস্রোতা নদীটি পানিতে থৈ থৈ করে, তাই অনেকটা কষ্ট করেই যাতায়াত করতে হয় এলাকার মানুষজনকে। তবে অজপাড়াগ্রাম হলেও এই গ্রামটি যেন চাঁদের আলো হয়ে এসেছে এক অদম্য মেয়ে। সে আর কেউ নন, নারী ফুটবলার মারিয়া মান্দা।

শহরের সব আলো-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন এই অদম্য কিশোরী। তার লড়াইয়ের গল্প যে কারও চোখ ভেজাবে। গারো পাহাড়ের কোলে এক গারো পরিবারে জন্ম হয় মারিয়ার। বাবা অনেক আগেই মারা যাওয়ায় সংসার চলে শুধু মায়ের রোজগারে। মায়ের রোজগারের পথ ছিল অন্যের বাড়িতে কাজ করা। টানাপোড়েনের জীবনেও ফুটবল নিয়ে নিজের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন অদম্য মারিয়া। শুধু মারিয়া একাই নন, শিরোপাজয়ী মেয়েদের প্রায় সবার গল্পগুলোও প্রায় একই।

সাফ চ্যাম্পিয়ন এই দলে আছেন কলসিন্দুর গ্রামের মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার। সিরাত জাহান স্বপ্নার বাড়ি রংপুর। আঁখির বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বাংলাদেশ অধিনায়ক এবং গোল্ডেন বুটজয়ী সাবিনা খাতুন এবং মাসুরা সাতক্ষীরার মেয়ে। কৃষ্ণা টাঙ্গাইলের, মনিকা আর রূপনা রাঙামাটির। আনাই আর আনচিং যমজ বোন খাগড়াছড়ির। নীলুফার ইয়াসমিন কুষ্টিয়ার।

নারী ফুটবলাররা দেশের মানুষের জন্য উৎসবের উপলক্ষ্ এনে দিয়েছে। অথচ মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে খেলবেন, একসময় অনেকেই তা মেনে নিতে চাননি। সমাজের সেই রক্ষণশীলতার পর্দা ছিঁড়ে এ দেশে প্রথম মেয়েদের ফুটবল অনুশীলন শুরু করেছিলেন প্রয়াত কোচ সাহেব আলী। আজ বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন তিনিই। তিনি এবং আরো যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এমন সাফল্য ধরা দিয়েছে, তাঁদের সবার প্রতি রইল শ্রদ্ধা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; সৌজন্যে: সময় টিভি

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Video