চাটগাঁইয়া বাংলায় ধাঁধাকে বলা হয় শোলক ('শ্লোক'-এর অপভ্রংশ) বা 'হঁলা' ( 'হেঁয়ালি'র অপভ্রংশ)। চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেসব ছেলে ভোলানো আমরা শৈশবে শুনেছি, সেগুলো এখন আর তেমন শোনা যায় না। আরো অনেক ঐতিহ্যিক বস্তুর মতো পুরোনো শোলকগুলো বিলুপ্তির পথে, নতুন শোলক সৃষ্টি হচ্ছে না।
চাটগাঁইয়া শোলকগুলো অবিকল বা অঞ্চলভেদে ঈষদ ভাষাগত পরিবর্তিত রূপে বাংলার এপারের ওপারের অনেক জেলাতেই ছিল, আছে বা থাকতে পারে। এগুলো কম-বেশি আপনাদের অনেকেরই জানা, আবার কিছু হয়তো অজানা। এখানে শৈশবশ্রুত এবং এখনও স্মৃতিতে অবশিষ্ট থাকা কয়েকটা শিশুতোষ শোলক তুলে ধরতে চাই, যেগুলোর রহস্যভেদের চেয়েও আঞ্চলিক ভাষাভঙ্গির সাবলীল, সপ্রতিভ উপস্থাপনা শৈশবে যেমন মুগ্ধ করতো তার অনুপম দোলায়, এখনও সমান মুগ্ধ করে ছন্দোবৈচিত্র্যের সচেতন বিশ্লেষণে।
না বললেও হয়তো চলে যে এসব ছড়ার বেশির ভাগই মা-ঠাকুমা, দাদি-নানিদের বা শিশু-কিশোরদের নিজেদেরই রচনা। কালভেদে বা এলাকাভেদে এগুলোর রূপ কিছুটা এদিক-সেদিকও হয়েছে। চট্টগ্রামে প্রচলিত বা লুপ্তপ্রায় অসংখ্য শোলক-হঁ'লার মধ্যে থেকে অল্প কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হল।
১.
লাইয়র উ'রদি লাই
টেপ পড়িয়া যায়
সোনার মেডেল ভাঁ'ই গেলে
জোড়া দ্য'ন্তি নাই।
(লাইয়ের ওপর লাই
টোল পড়ে যায়,
সোনার মেডেল ভেঙে গেলে
জোড়ার উপায় নাই।)
ধাঁধা: সোনার মেডেল মানে কী?
উত্তর: ডিম
['লাই' একটি চট্টগ্রামি শব্দ। লাই হল একধরনের বড় বেতের ঝুড়ি বা টুকরি। টেপ আরেকটা চাটগেঁয়ে শব্দ, যার মানে হল 'টোল'। ডিমভর্তি লাই একটার ওপর আরেকটা রাখলে তাতে ওপরের লাইয়ের তলায় টেপ পড়ে গিয়ে ডিম ভেঙে গেলে তা আর জোড়া লাগানো যাবে না।]
২.
এই ঘরর বুড়ি ওই ঘরৎ যায়
ধুম্মুর ধুম্মুর আছার খায়।
(এঘরের বুড়ি ওঘরে যায়
দুম দুম আছাড় খায়।)
উত্তর: ঝাড়ু (চাটগেঁয়ে ভাষায় 'পিছা')
['ধুম্মুর ধুম্মুর' একান্তভাবে একটা চাটগাঁইয়া যুগ্মশব্দ। চট্টগ্রামের লোকজন বিশেষত বর্ষাকালে পিছল মেঠো রাস্তায় আকছার 'ধুম্মুর ধুম্মুর আছার' খায় বটে।]
৩.
ছ'ল লুডে,
দড়ি হাঁডে।
(ছাগল পা গুটিয়ে বসে থাকে,
দড়িটা হাঁটে।)
উত্তর: কুমড়ো (চাটগেঁয়ে 'কোঁ'ড়া') আর কুমড়োলতা
[গরু-ছাগল, কুকুর-বিড়াল ইত্যদির মাটিতে লুটিয়ে চার পা গুটিয়ে বসে বা ঘুমিয়ে থাকা অর্থে 'লুডে' কথাটির বহুল ব্যবহার আছে, একান্ত চাটগাঁইয়া ধরনে। প্রয়োগ: আঁ'র-অ কুত্তা তোঁয়ার-অ দোয়ারৎ ক্যা লুডে? মানে, আমাদের কুকুর তোমাদের দুয়ারে বসে বা ঘুমায় কেন?]
৪.
চাইর-অ মিকখাদি লোয়ার আইল
মইধ্যে পানি কুন্দি আইল?
(চারপাশে লোহার আল
মধ্যে জল কোথা দিয়ে এল?)
উত্তর: নারিকেল (চাটগেঁয়ে নাইরগল বা নাইজ্জল)
['চাইর-অ মিকখাদি' মানে 'চার মুখ বা দিক দিয়ে']
৫.
উয়রেরতুন লাইম্যে বুড়ি ক্যাঁথাকানি লই,
হেই বুড়িয়ে কথা ক'র যে সভার মাঝে ব'ই।
(উপর থেকে নেমেছে বুড়ি ক্যাঁথাকানি নিয়ে,
সেই বুড়ি কথা বলছে সভার মাঝে বসে।)
উত্তর: পুঁথি
[উপরের তাক থেকে লাল সালু বা পাটকাপড় জড়ানো পুঁথি নামিয়ে আসরে পাঠ করার কথা বলা হচ্ছে।]
৬.
চিৎ হই বুড়ি রইয়ে পড়ি
তিন ঠ্যাং উয়া করি।
[চিত হয়ে বুড়ি রয়েছে পড়ে
তিন ঠ্যাং উপরে তুলে।)
উত্তর: উনুন (চাটগেঁয়ে-- চুলা)
৭.
কন্ প'লির থে তিনউয়া দুধ
যে কইৎ ন পারিব, তে প'লির পুৎ।
(কোন্ পাগলির তিনটা দুধ
যে বলতে পারবে না, সে পাগলির পুত।)
উত্তর: উনুন (চুলা)
[ছেলেবেলায় এ শোলকের ঠিক জবাব দেয়ার জন্যে বালকদের কত যে আকুলি বিকুলি দেখেছি। কারণ কেউই পাগলির পুত্র হতে চায় না। তবে বালিকারা অপেক্ষাকৃত নির্বিকার থাকত, কারণ তারা পুত নয়, ঝি, এবং ঝিদের ব্যাপারে শোলকে কোনো হুঁশিয়ারি দেয়া হয়নি।]
৮.
রাজার-অ পইরৎ হাজার ইচাগুরা
এক্কই টিপে বেয়াগ্গুন মরা।
(রাজার পুকুরে হাজার কুচো চিংড়ি
একটা টিপে সব কটা মরা।)
উত্তর: লেবু
['ইচাগুরা' বা আরো সংক্ষেপে 'ইচূ'রা' খাঁটি চট্টগ্রামি শব্দ, যার মানে হল গুঁড়ো ইচা বা খুদে চিংড়ি বা কুচো চিংড়ি। ইচামাছ মানে হল চিংড়িমাছ। 'কেঁডা ইচা' মানে হল গলদা চিংড়ি, 'ছোঁয়া ইচা' মানে বাগদা চিংড়ি।]
৯.
চিঁ চিঁ পাতা, বোঁ বোঁ ডাল,
ফলউয়া বেঁকা, বিচিউয়া লাল।
(খুদে খুদে পাতা, বড় বড় ডাল,
ফলটা বাঁকা, বিচিটা লাল।)
উত্তর: তেঁতুল (চাটগেঁয়ে 'তেতই')
[এ শোলকে পাতা ও ডালের ধরন বোঝানোর জন্যে দুটো চমৎকার বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে-- চিঁ চিঁ এবং বোঁ বোঁ, যেগুলো অর্থহীন হয়েও অর্থব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে কেবলমাত্র প্রয়োগের গুণে।]
১০.
গাছ ছালউয়া,
পাতা ঢালউয়া,
দেখতে হিঁডা,
খাতে মিডা।
(গাছ ছালে ঢাকা,
পাতা ঢালের মতো বড় আর চ্যাপ্টা,
দেখতে সিঁটিয়ে যাওয়া গোছের,
খেতে মিঠা।)
উত্তর: পেঁপে (চট্টগ্রামী ভাষায় 'কইয়া')
['ছালউয়া', 'ঢালউয়া' এগুলো পুরোপুরি চাটগাঁইয়া বিশেষণ বাচক শব্দ, যদিও প্রমিত বাংলা ভাষার হরফ দিয়ে শব্দগুলোর প্রকৃত উচ্চারণ পুরোপুরি বোঝানো যাচ্ছে না। ছালউয়া মানে তন্তুময়, ঢালউয়া মানে ঢালের মতো চ্যাপ্টা, 'একঢাল চুল' বলতে যেমনটা বোঝায়। 'হিঁডা' শব্দটা আরেকটা টিপিক্যাল চাটগাঁইয়া শব্দ, যেটা এসেছে 'সিঁটানো' থেকে। কেউ বা কোনোকিছু (যেমন ফলমূল) শুকিয়ে রোগা হয়ে গেলে বা কুঁচকে গেলে তখন সেটাকে 'হিঁডা' বলা হয়।]
এরকম আরো অজস্র ধাঁধা চট্টগ্রামে লোকমুখে প্রচলিত আছে বা ছিল, যেগুলো নিয়ে আগামীতে আরো আলোচনা ও উদ্ধরণের ইচ্ছে রইলো।
মন্তব্য করুন