চট্টগ্রাম রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১
চট্টগ্রাম রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১

সংস্কৃতি

জ্যোতির্ময় নন্দী

চট্টগ্রামে মনসা পূজা ও বাইশ কবির পুঁথি


প্রকাশিত : রবিবার, ২০২২ জুলাই ১৭, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

শিবের মানসকন্যা-রূপে পরিচিতা অবৈদিক নাগদেবী মনসা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বঙ্গদেশে বহুমান্যা ও বহুলপূজিতা। পুরাণ গ্রন্থমালায়  পদ্মপুরাণ-এ মনসা বা পদ্মাবতীর কাহিনি পাওয়া যায় । তাঁকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগীয় পুঁথিসাহিত্যে মনসামঙ্গল নামে একটা বিশেষ ধারাই গড়ে ওঠে, যে-ধারার প্রধান কবি হিসেবে গণ্য করা হয় বিজয় গুপ্তকে।

 

চট্টগ্রামে কিন্তু বাইশ কবির মনসাপুঁথি-ই প্রচলিত। শ্রাবণ মাসে মনসা পূজা উপলক্ষে সারা মাস ধরে পুঁথিটি পাঠ করে শেষ করা বাধ্যতামূলক। বাংলার সব অঞ্চলের মধ্যে পাহাড়-অরণ্যবহুল, সর্পসঙ্কুল চট্টগ্রামে মনসাপুজোর ধুমধাম সবচেয়ে বেশি, এবং অন্যন্য অঞ্চলের তুলনায় অন্যরকম। চট্টগ্রামে শুধু নাগপঞ্চমী তিথিতে, অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের শুক্লাপঞ্চমী ও কৃষ্ণাপঞ্চমীতে নয়, পুরো শ্রাবণ মাসই দেবী মনসার ঘটের পুজো করা হয়। এ ঘট স্থাপন করা হয় শ্রাবণ মাসের প্রথম দিন, এবং সেইসঙ্গে সূত্রপাত করা নিত্যদিনের ঘটপূজার পাশাপাশি মনসাপুঁথি পাঠের।  শেষদিন মহাধুমধামে চূড়ান্ত পূজার মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী মনসা অর্চনা তথা পুঁথিপাঠের সমাপ্তি ঘটে। মনসা পূজায় ছাগল, হাঁস, পায়রা প্রভৃতি বলিদান করে না এমন গেরস্থ খুব কমই দেখা যায় চট্টগ্রামে।


আমাদের শৈশবের পল্লীজীবনে মনসা পুজো ছিলো বার্ষিক বড় বড় ঘটনাগুলোর একটি। বর্ষণমন্দ্রিত শ্রাবণের রাতগুলো তখন গুঞ্জরিত হতো মনসা পুঁথি পাঠের সুরে। ঘরে ঘরে নারী-পুরুষ এ পুঁথি পাঠ করতো তাদের পারিবারিক মনসা পুজোর অঙ্গ হিসেবে। আবার পেশাদার পুঁথিপাঠকদের আসরও বসতে পালাক্রমে এর ওর বাড়িতে। মনসার কাহিনিভিত্তিক কবির লড়াই বা পাল্টাগানও হতো বিস্তর, যেগুলো ছোট-বড় সবাই খুব উপভোগ করতো।

 

মনসার ঘট বসার পর পুরো শ্রাবণ মাস সাপ হত্যা, এমনকি সাপকে আঘাত করা বা তাড়ানো ছিলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ সময় বাড়ির আশেপাশে বা উঠোনে বা পুজোমণ্ডপের ধারেকাছে সাপ দেখলে বিশেষ করে বয়ঃপ্রবীণরা খুশিই হতেন।

 

মনসা পুজোর সেই ধুমধাম এখনও আছে, তবে তার চেহারা অনেক বদলে গেছে। পুঁথিপাঠের বদলে মাইকে পুঁথিপাঠের রেকর্ড বাজানোতেই এখন মানুষের আগ্রহ বেশি। পুঁথিপাঠের আসর বসে না বললেই চলে। টিভি-ইণ্টারনেটভিত্তিক বিনোদনের ভিড়ে পুঁথি পাঠ বা শোনা কোনোটারই সময় এবং ইচ্ছে মানুষের তেমন আছে বলে মনে হয় না। তবে পশুবলিটা এখনও হয় সমান উন্মাদনার সঙ্গেই। সাত্ত্বিক ভক্তির আকাল দেখা গেলেও তামসিক ভক্তির অভাব নেই! সেটাই বা মন্দ কী? রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, ভক্তির তমো ভালো!

 

প্রচলিত পঞ্জিকামতে গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে মনসার ঘট প্রতিষ্ঠা ও অধিবাস হয়ে গেছে। আজ শনিবার  শ্রাবণ হল প্রথম পূজা। আগামীকাল হবে নাগপঞ্চমীর পূজা। এভাবে সারা শ্রাবণ মাস ধরে প্রতিষ্ঠিত ঘটের পুজো হবে। অবশেষে শ্রাবণের শেষ তারিখে পশু-পাখি বলির মাধ্যমে পঞ্চোপচারে দেবীর পুজো করে এ ঘট বিসর্জন দেয়া হবে। সেইসঙ্গে সারা মাস ধরে চলবে বাইশ কবি বিরচিত মনসা পুঁথি পাঠ।

 

সুদূর রাজধানীতে বসে, নাগরিক আগুনে দগ্ধ হতে হতে বসে চট্টগ্রামের পল্লী অঞ্চলের মনসা পুজোর সঙ্গে জড়িত শৈশবস্মৃতি, নস্টালজিক অনুভব ইত্যাদি থেকে আমার  লেখা একটা কবিতা নিচে সংযোজন করা হল:

 

ও মা মনসা

 

নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসে পুঁথি পাঠের সুর

ও মা মনসা, পুরাও আশা, ডাকি তোমারে.

শ্রাবণে অঝোর ধারা ঝরে ঝরো ঝরো।

ব্যাঙের কোরাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দূর থেকে

টুকরো টুকরো সুর ধুয়া ঘোষা ভেসে আসে কানে

ও মা জয় বিষহরি, তোমার অনন্ত লীলা বুঝিতে না পারি…”

 

গ্রাম বাংলা, হারানো শৈশব, মৃত জোনাকিরা সব

টিপ টিপ আলো জ্বালে ক্ষীয়মাণ নিউরোনে,

টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা খসে পড়ে স্মৃতিভ্রষ্ট শালুক পাতায়।

 

শ্রাবণ এলে চোখ বুঁজে দেখি

উঠোনে শঙ্খ লাগা সর্পযুগল,

মনসা ঘটের পেছন থেকে সর সর করে

সরে যায় প্রবীণ দাঁড়াশ।

ঠাকুমা গলায় আঁচল দিয়ে নাগদেবীকে

গলদশ্রু প্রণাম জানায়।

 

শ্রাবণ সন্ধ্যায় যত কচিকাঁচা মেতে ওঠে উদ্দাম আরতিতে।

অথচ এবার পুরোটা শ্রাবণ জুড়ে একফোঁটা বৃষ্টি নেই।

অপ্রাকৃত খরায় পুড়ছে দেশ-কাল,

ভ্যাপসা গরমের মধ্যে জেগে ওঠে বিবর্ণ সকাল।

তবুও গভীর রাতে বিছানায় আধোঘুমে

এপাশ ওপাশ করতে করতে শুনি

কোন সুদূরের পার হতে ভেসে আসে পুঁথিপাঠ

ও মা মনসা, পুরাও আশা ডাকি তোমারে…”

 

আজকাল আমাদের আশাগুলো বৃদ্ধ সাপের মতো

চলে গেছে অকালের শীতঘুমে।

সর্পদেবীর ডাকেও নাগলোক নিথর হয়ে থাকে,

বেহুলাকে দেখতে হলে ইউটিউবই একমাত্র ভরসা

 

ও মা জয় বিষহরি, তোমার অনন্ত লীলা বুঝিতে না পারি…”

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Video