দীর্ঘ ৭ বছরের অচলাবস্থার পর চীনের মধ্যস্থতায় নিজেদের মধ্যে
সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে সম্মত হয়েছে ইরান ও সৌদি আরব। ১০ মার্চ শুক্রবার চীনের
রাজধানী বেইজিংয়ে তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার
বিষয়ে চীনের দেয়া একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিরা।
এ সময় ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি এবং সৌদি জাতীয়
নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাইদ আল-আইবান উপস্থিত ছিলেন।
রিয়াদ এবং তেহরানের মধ্যে বৈরিতার অবসান এবং সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া
হচ্ছে ২০২১ সাল থেকেই। সাবেক ইরাকি সরকার দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে
আসছিল। বাগদাদে ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিদের মধ্যে ৫ দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত
হয়েছে। দুই দেশের কর্মকর্তারা সুস্পষ্টভাবে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার
উপর জোর দিয়েছিলেন এবং অবশেষে চীনের মধ্যস্থতায় দুইপক্ষ সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের
লক্ষ্যে একটি চুক্তিতে পৌছাতে এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে।
রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বহাল হওয়াকে
আমেরিকা ও ইসরাইলের ব্যর্থতা হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। একদিকে এই গুরুত্বপূর্ণ
ইস্যুটি বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের মধ্যস্থতায় হয়েছে। অন্যদিকে এই চুক্তি সৌদি আরব ও ইরানের
মধ্যে ব্যবধান ও বিভেদ সৃষ্টির ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ব্যর্থতার
দিকটি তুলে ধরছে।
জাতিসংঘে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থায়ী মিশন এক বিবৃতিতে
বলেছে, ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যে চুক্তি
হয়েছে তার কারণে ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি দ্রুততর হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো
রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্বহাল চুক্তি পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে গঠনমূলক
প্রভাব ফেলবে। ফলে এই চুক্তির ঘোষণা এ অঞ্চলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এবং এই অঞ্চলের
বিভিন্ন দেশ তাকে স্বাগত জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির
আবদুল্লাহিয়ান একটি টুইটে লিখেছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে
স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রত্যাবর্তন দুই দেশ, অঞ্চল এবং ইসলামিক বিশ্বের জন্য
দুর্দান্ত সক্ষমতা বয়ে আনবে।
এদিকে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার শান্তি চুক্তিকে স্বাগত
জানিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কারবি বলেছেন, “ইয়েমেন যুদ্ধের অবসানে
যেকোন উদ্যোগ এবং মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা নিরসনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই আমরা”। জন কারবি বার্তা সংস্থা
রয়টার্সকে বলেন, সাধারণভাবে বলতে গেলে, আমরা ইয়েমেনে যুদ্ধের অবসান এবং
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করার জন্য যেকোনো প্রচেষ্টাকে স্বাগত
জানাই। গত বছর এই অঞ্চল সফরের সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে নীতির রূপরেখা
দিয়েছিলেন তার মূল স্তম্ভ হলো প্রতিরোধের পাশাপাশি সংঘাতের অবসান এবং কূটনীতি।
অন্যদিকে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট এই
চুক্তিকে ইরানের জন্য রাজনৈতিক বিজয় এবং ইসরাইলের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক ঘটনা
বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ইরান-বিরোধী আঞ্চলিক জোট গঠনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি
মারাত্মক বিপর্যয়। ইসরাইলের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদও এই চুক্তিকে
ইসরাইলের জন্য বিপজ্জনক ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ইরান ও সৌদি আরবের
মধ্যকার এই চুক্তি ইসরাইল সরকারের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মারাত্মক ব্যর্থতা। এছাড়া,
ইসরাইলের সাবেক যুদ্ধমন্ত্রী বেনি গান্তজ ইরান-সৌদি চুক্তিকে ইসরাইলের জন্য
উদ্বেগের কারণ বলে উল্লেখ করেন।
২০১৬ সালে রিয়াদ ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য রিয়াদের পক্ষ থেকে অজুহাত ছিল তেহরান এবং মাশহাদে
অবস্থিত দেশটির দূতাবাস এবং কনস্যুলেটে হামলা। যদিও একদল দুষ্কৃতিকারীদের মাধ্যমে
চালানো এই হামলার নিন্দা জানিয়েছিল ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের এই পদক্ষেপের
প্রধান কারণ ছিল সে সময় রিয়াদের পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি। ২০১৫ সাল থেকে ২০২১
সাল পর্যন্ত সৌদি আরবের পরাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আক্রমণাত্মক। ফলে এ সময়
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে রিয়াদ সরকার তার এই নেতিবাচক
দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছে। এমনকি সৌদি আরবও ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার সর্বোচ্চ
চাপের নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
মন্তব্য করুন