চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ Jun ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২
চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ Jun ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

শিক্ষা

জ্যোতির্ময় নন্দী

সুদীপ্ত দেব: এক প্রবাসী প্রতিভার নাম


প্রকাশিত : শনিবার, ২০২২ Jun ১১, ০৬:৫১ অপরাহ্ন
স্বরচিত গ্রন্থ হাতে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা'র সঙ্গে সুদীপ্ত দেব (বামে)

সুদীপ্ত, বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও শিক্ষক সুদীপ্ত দেবের সঙ্গে দেখা হল অনেক বছর পর।  শেষবার ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সম্ভবত ২০১৫ বা ’১৬-র দিকে।  তখন ও বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা ক্যাম্পাসে সহযোগী অধ্যাপক, বিভাগীয় চেয়ারম্যান এবং ডিন পদে কর্মরত।  আমি নিজে তখন চাকরি করছি বৈশাখী টেলিভিশনে।  মহাখালীতে বৈশাখীর অফিস আর সুদীপ্তর বাসা আর কর্মস্থল পাশেই গুলশানে।  তখন একবার দেখা হয়েছিল।  নিতান্তই পথের দেখা। দু-চারটে খুচরো কথাবার্তা।  সুদীপ্তর ক্লাস অ্যাটেন্ডের তাড়া, আর আমার আসন্ন নিউজ বুলেটিন তৈরির জোর তাগাদা। কর্মব্যস্ত মহানগরীতে ছুটন্ত দুটো মানুষের কিছুক্ষণ একসঙ্গে বসে দুটো সুখদুঃখের কথা বলার অবকাশই ছিল না।

 

অথচ সুদীপ্তর সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় সাড়ে তিন দশকের পুরোনো।  আমার চেয়ে বছর দশেকের ছোট সুদীপ্ত নিজেই এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে পরিচয় করে নিয়েছিল।  সে তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।  শুনেছিলাম, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, ছাত্রলীগের কর্মী বা নেতা।

 

সম্ভবত ১৯৮৭-৮৮’র দিকে তার সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয়, তখন আমি চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণে কর্মরত। পূর্বকোণে তখন তার লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক নানা নিবন্ধ তখন ছাপা হচ্ছে।  রাজনীতি করলেও একাডেমিক লেখাপড়াতে সে কখনও হেলাফেলা করেনি।  তার শিক্ষাজীবন আগাগোড়াই কৃতিত্বে উজ্জ্বল।  চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিডস হাই স্কুল ও চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মেধাতালিকায় জায়গা নিয়ে এসেএসসি ও এইচএসসি করার পর, পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স দুটোতেই সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিল।

 

সুদীপ্ত যখন ছাত্রলীগের রাজনীতি করছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা চট্টগ্রামের প্রায় সমস্ত প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন বিশেষ একটি ছাত্র সংগঠনের একছত্র  আধিপত্য বিস্তারের কারণে প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতিকে প্রবল বৈরিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছিল, যা প্রায়শই সশস্ত্র সংঘর্ষ ও প্রাণহানির দিকে গড়াচ্ছিল। ছাত্রলীগের বিস্তর নেতা-কর্মী তখন ওই প্রগতিবিরোধী বিশেষ ছাত্র সংগঠনঠির ক্যাডারদের হামলায় হতাহত হচ্ছিল। সুদীপ্ত দেব সেই প্রবল বৈরী সময়ে ছাত্রলীগ করেছে। ১৯৮৯ সনের চাকসু নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে সে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে বার্ষিকী সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিল। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সে-সময়কার চাকসু বার্ষিকীগুলোও হয়েছিল বহু ভালো লেখায় ঋদ্ধ আর সুসম্পাদনার সাক্ষ্যবহ। সুদীপ্ত নিজে গাঁটের পয়সা খরচ করে ঘুরে ঘুরে, প্রয়োজনে তাগাদা দিয়ে কবি, লেখক, প্রাবন্ধিকদের কাছ থেকে লেখা যোগাড় করছে দেখেছি।

 

শিক্ষাজীবন শেষ করে সে প্রথমে যোগ দিয়েছিল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে। তারপর একসময় যোগ দেয় বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।  সেখানকার সহযোগী অধ্যাপক থাকাকালে সে চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার পর যোগ দেয় সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের কুইন্স কলেজে।  নিউ ইয়র্কে সে Sunshine Tutoring & Information Technology Services-এর প্রেসিডেন্ট।  তার বর্তমান গবেষণার বিষয়বস্তু হল ন্যানো পার্টিকলস বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা।  বিশ্বস্রষ্টা গড পার্টিকল বা ঈশ্বর কণাও।  থিয়োরি অব এভরিথিং তার ভাবনাচিন্তার বিষয়।  পদার্থ বিজ্ঞানের সর্বশেষ অগ্রগতির সঙ্গে সে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

 

কর্মজীবনে তার সাফল্য প্রশ্নাতীত।  কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে সে বড় গৃহকাতর হয়ে উঠেছে।  দেশে এখনও তার শেকড় তার বাবা অর্থনীতির স্বনামধন্য অধ্যাপক সুশান্ত দেব, মা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশান উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসররপ্রাপ্ত শিক্ষিকা শিখা দাশ (দেব) আর ছোটভাই রয়ে গেছে।  অধ্যাপক সুশান্ত দেবকে একসময় সীতাকুণ্ড কলেজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলা হত। অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সে তিন এখন শারীরিক তেমন সুস্থ নন সঙ্গত কারণেই, খানিকটা স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছেন।

 

ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সুদীপ্ত দেবের প্রবন্ধ-নিবন্ধাদি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।  গ্রন্থও আছে একাধিক।  সম্প্রতি বেহুলা বাংলা থেকে প্রকাশিত তার ‘ন্যানোটেকনোলজি থেকে সৌরশক্তি: সত্যের সন্ধানে বিজ্ঞান’ বইটি হাতে এসেছে।  সাধারণ পাঠকের বোধগম্য ভাষায় একটা জটিল বিষয়ের মনোজ্ঞ উপস্থাপনা রয়েছে এ বইটিতে।

 

সুদীপ্ত কয়েকদিন আগে দেশে এসেছে মায়ের গুরুতর অসুস্থতার খবর পেয়ে।  এখন মা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, আর তাই সে আবার যুক্তরাষ্ট্রে তার কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছে।  আগামীকাল রোববার তার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে নিউ ইয়র্ক রওনা হওয়ার কথা।

 

১৯৮০’র দশকের শেষদিকে দৈনিক পূর্বকোণে আমার চাকরিকালে পত্রিকাটায় প্রকাশিত সুদীপ্ত দেবের নিবন্ধগুলো যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।  তার লেখা যে-বইটা আমার হাতে এসেছে, সেটাও সাধারণ পাঠক সাগ্রহে গ্রহণ করেছে। বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখিতে তার মতো মানুষের প্রয়োজন এ মুহূর্তে বড় বেশি, যখন অবৈজ্ঞানিক মূঢ় মূর্খ চিন্তায় দেশ ভরে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে তার পূর্ণোদ্যম প্রত্যাবর্তন কামনা করি।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Video