ইতিহাসবিদ অধ্যাপক
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, পংকজ ভট্টাচার্যের সংগ্রাম ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ফিরিয়ে
আনার সংগ্রাম। তিনি আমৃত্যু সেই সংগ্রামের রাজনীতিই করে গেছেন। আবার তিনি সামাজিক আন্দোলনের
ওপরও জোর দিয়েছিলেন। মানুষকে মুক্তি দিতে হলে সমাজের মধ্য থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে
তুলতে হবে, রাজনীতি একটি স্তর, কিন্তু সামাজিক আন্দোলন একটি বৃহৎ পরিসর, সেখানে কাজ
করতে হবে। পংকজ ভট্টাচার্য এই সামাজিক আন্দোলনের দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পণ করে চলে
গেছেন। আমরা যদি প্রকৃতই উনাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই, তাহলে উনার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে
যেতে হবে। উনার দেখানো পথে মানুষের বাসযোগ্য রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রাম চলবে।
১০ জুন শনিবার
বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য ন্যাপের সভাপতি
প্রয়াত পংকজ ভট্টাচার্যের নাগরিক স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘জননেতা পংকজ ভট্টাচার্য
নাগরিক স্মরণসভা পরিষদ’ এর আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিষদের
আহবায়ক কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, শুধু মেট্রোরেল আর সড়ক সেতু
মানেই উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন হল সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি। শতভাগ সমতা কোথাও, কোনো রাষ্ট্রে
হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রকে সমতার পথে হাঁটতে হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সম্প্রতি যে বাজেট
ঘোষণা হয়েছে, সেখানে আমরা সমতার কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি। বাজেটে দারিদ্র্যমুক্তি আর
শোষণমুক্তির কোনো লক্ষ্য নেই। সমতাভিত্তিক বাজেট আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর আমলে। জিয়াউর
রহমানের আমল থেকে শুরু হয় আমলাতান্ত্রিক বাজেট। এরপর থেকে আমলাতান্ত্রিক বাজেট চলছে
তো চলছেই, যেন কাঁঠালের আমসত্ত্ব।
দেশ থেকে রাজনীতি
বিদায় নিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর পথে
হাঁটছে না। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ১৭ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ
হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র, যার ভিত্তি কোনো ধর্ম হবে না। কিন্তু আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম
আছে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আর থাকল কই?
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট
পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম বলেন, ‘পংকজ ভট্টাচার্য
একজন রাজনীতি অন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন। উনার গড়ে তোলা ঐক্য ন্যাপের সঙ্গে আমরা সিপিবি
যুগপৎ ধারায় আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে আছি,
যে গণতন্ত্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে নির্বাসনে আছে। আজ সমাজ দখলে নিয়েছে মৌলবাদি-সাম্প্রদায়িক
শক্তি আর রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে লুটেরা গোষ্ঠী। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্প্রদায়িকতার
বিরুদ্ধে লড়তে হবে। টেকসই গণতন্ত্র ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ সাম্প্রদায়িকতামুক্ত
দেশ হবে না।
কবি ও সাংবাদিক
আবুল মোমেন বলেন, পংকজদা কখনও মানসিকভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হননি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা,
একের পর এক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি মাথা উঁচু করে মূলধারায় নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকেছেন।
আজীবন একই ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ধারার প্রতি বিশ্বাসে অটল ও সক্রিয়
থেকেছেন। দেশের পরিস্থিতি কখনও কখনও তাঁকে হতোদ্যম করলেও তিনি কর্তব্য ভোলেননি। সংখ্যালঘু
মনস্ত্বত্ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ না করে নাগরিক উদ্বেগ নিয়ে ছুটে গেছেন উপদ্রুত এলাকায়।
হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান, আদিবাসী- সবার মধ্যে একাকার থেকে তিনি একজন বিশিষ্ট
বাঙালি হয়েছিলেন।
হিন্দু বৌদ্ধ
খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশের
কোনো রাজনৈতিক দল আজ মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে তাদের অন্তরে ধারণ করে না, রাজনীতিতে ধারণ
করে না। ১৯৭৫ সালের পর আমরা বাংলাদেশকে হঠাৎ পাকিস্তান হয়ে যেতে দেখেছিলাম। আর আজকের
বাংলাদেশকে দেখছি ক্রমশঃ আফগানিস্তান আর ইরানের দিকে ছুটতে। বাংলাদেশে সংবিধান সাম্প্রদায়িকতার
আবরণে বন্দি। এই জগাখিঁচুড়ি মার্কা সংবিধান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হবে না, যারা
হওয়ার কথা বলেন তারা আসলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেন।
‘জননেতা পংকজ ভট্টাচার্য
নাগরিক স্মরণসভা পরিষদ’র সমন্বয়কারী ও চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির
সভাপতি অশোক সাহা’র সঞ্চালনায় স্মরণসভায় আরও বক্তব্য রাখন,
শিক্ষাবিদ রনজিৎ কুমার দে, ঐক্য ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ সবুর ও প্রেসিডিয়াম
সদস্য অলিজি হাসান, প্রবীণ শ্রমিক নেতা আহসান উল্লাহ চৌধুরী ও তপন দত্ত, সাবেক ছাত্রনেতা
আবু তাহের মাসুদ ও ডা. মানস বসু এবং আদিবাসী ফোরামের শরৎজ্যোতি চাকমা।
স্মরণসভার শুরুতে
শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন শিল্পী শীলা মোমেন। পংকজ ভট্টাচার্যের জীবনী পাঠ করেন সাংস্কৃতিক
সংগঠক শীলা দাশগুপ্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রয়াতের
প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
উল্লেখ্য, ৮৩ বছর বয়সী বামপন্থী রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য গত ২৩ এপ্রিল রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়।
- প্রেস বিজ্ঞপ্তি
মন্তব্য করুন