বাঙালি জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিবেচনা করলে একটা জিনিস সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক না হলেও তারা অত্যন্ত মাতৃভক্ত জাতি। এ জাতির একাংশ ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় মাতৃপূজারী। এই মাতৃপূজাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের সুবিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, যাতে অবদান রেখেছেন মধ্যযুগের কবি-গীতিকার ভারতচন্দ্র-রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত থেকে আধুনিক কালের কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত। বাঙালির বৃহত্তর আরেক অংশও কিন্তু মাতৃভক্ত কম নয়। তারাও মনে করে, মায়ের পায়ের নিচেই তাদের স্বর্গ। জনপ্রিয় সঙ্গীতেও দেখা যায় তার প্রতিধ্বনি--
মাগো, তোর পায়ের তলে বেহেশত
আমার
মাগো, তুই খোদাতালার সেরা
উপহার...
নিজের দেশকেও সে মনে করে বাবার সমান নয়, মায়ের সমান; এবং এ ভূমিকে মনে করে
পিতৃভূমি নয়, মাতৃভূমি; এবং নিজের ভাষাকে পিতৃভাষা নয়, মাতৃভাষা। নৃতাত্ত্বিক বা
জাতিতাত্ত্বিক দিক থেকেও এটা সত্য বটে। একইসঙ্গে সে মা আর মাতৃভূমিকে স্বর্গের
চেয়েও গরিয়সী বলেছে।
বাঙালি তার সব দুঃসময়ে দুর্যোগে যেন চেতনে বা অবচেতনে মনে করে, প্রার্থনা
করে যে, কোনো ‘মাদার ফিগার’ এসে তাদের এ সঙ্কট থেকে ত্রাণ করুক। কিন্তু যেজন নিতান্ত শৈশবেই মাতৃহারা
হয়েছে, তাকে কে ত্রাণ করে? প্রায়শই দেখা যায়, মাতৃহারা শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছে,
তাকে আপন সন্তানের মতো লালন পালন করে, সব বিপদ-আপদ থেকে তাকে নিজের আঁচলের আড়ালে
রক্ষা করে বড় করে তোলে তার বড়বোন, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন “জননীর প্রতিনিধি”।
আমাদের মহান নেত্রী শেখ হাসিনা জাতির সামনে সেই ‘জননীর প্রতিনিধি’ বড়বোন হিসেবে আবির্ভূত
হয়েছেন বললে বোধহয় কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না। ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বন্ধবন্ধু এবং
বঙ্গজননীসহ সব স্বজন নিহত হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শিশু জাতি যখন অথৈ পাথারে
নিক্ষিপ্ত হল, তখন রহমানুর রহিম আল্লাহ্তা’লার অসীম কুদরতে শেখ হাসিনা
আর তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে যান, হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে
থাকার সুবাদে। বঙ্গবন্ধুর এই বিবাহিতা ও দুটি সন্তানের জননী কন্যাটি অনতিদূর ভবিষ্যতে
একদিন জাতির কাণ্ডারী হয়ে উঠবেন, তা তখন কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
অথচ আল্লাহ্’র ইচ্ছায় সেটাই হল। ঘাতকগোষ্ঠী শাসিত স্বদেশ থেকে দীর্ঘ ছয়টি বছর বাইরে
নির্বাসিত থাকার পর ১৯৮১-তে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। ঝড়ের মুখে কাণ্ডারীহীন
টালমাটাল নৌকার যাত্রী আওয়ামী লীগ উপায়ান্তর না দেখে নিহত জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ
সন্তান শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলীয় সভাপতি পদে নির্বাচিত করে। দলের তথা
দলের বাইরেরও অনেক শুভার্থী সুহৃদের একান্ত অনুরোধে দেশে ফিরেই তিনি এতিম শিশু
জাতিটিকে পরম মমতায় বুকে টেনে নেন। তারপর থেকে সুদীর্ঘ চার দশকাধিক কাল ধরে
বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতির জন্য তিনি যা করেছেন, যেভাবে তিনি অসহায় সেই
শিশুরাষ্ট্রটিকে সুদৃঢ়ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো স্বয়ম্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন,
তাতে বলতে হয় তিনি জাতির জনক ও জননী দুয়েরই ভূমিকা পালন করেছেন আর করে চলেছেন, এবং
সেক্ষেত্রে তাঁকে কবিগুরু কথিত শুধু ‘জননীর প্রতিনিধি’র চেয়েও বড় কিছু বলতে হয়।
তিনি একাধারে ‘জনক ও জননীর প্রতিনিধি’।
কথাটা ব্যাখ্যা করা দরকার। শেখ হাসিনা জননীর প্রতিনিধি এ অর্থে যে, মায়ের বা
বড়বোনের স্নেহমমতায় তিনি জাতিকে শুধু আগলেই রাখেননি, পিতৃহত্যার শোকে দুঃখে
বিস্ময়ে আতঙ্কে বোবা হওয়া জাতির মুখে তিনি আবার বোল ফুটিয়েছেন, আবার তার কণ্ঠে
তুলে দিয়েছেন সেই তেজোদৃপ্ত ধ্বনি-- ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ’৭৫-পরবর্তী বছরগুলোতে যে স্লোগান,
যে নামোচ্চারণ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, যা উচ্চারণ করলে নির্যাতিত, দণ্ডিত
হতে হত। তিনি ক্ষুধার্ত, খাদ্যাভাবগ্রস্ত জাতির মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন, তাকে
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। কে না জানে, মুখে বুলি ফোটানো, মুখ অন্ন তুলে দেয়া
মায়ের বা মাতৃস্থানীয়ার কাজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল সহা, সকল বহা
মাতার মাতা।
এভাবে শেখ হাসিনা জাতির চোখে জননীর প্রতিনিধিস্থানীয়া হয়ে ওঠেন, কিন্তু তার
চেয়েও বেশি তাঁকে জনকের প্রতিনিধি বলেই মনে হয়েছে, যখন জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা,
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সমুন্নত রাখা, যুদ্ধাপরাধীদের ও সপরিবারে জাতির পিতার
হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা প্রভৃতি দাবিতে তাঁর বজ্রকণ্ঠ বাংলার দিকে
দিগন্তরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ১৯৮১-তে দেশে ফেরার পর থেকে এসব দাবি নিয়ে
বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত জনসভা করে বেরিয়েছেন শেখ হাসিনা,
যা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো জয় পাওয়ার
আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি থানা সদরে বঙ্গবন্ধুর জনসভা করে বেড়ানোর
কথা।
সেটা ছিল সবে শুরু। ১৯৮১ থেকে ’৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় এক
দশক ধরে তিনি সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তুখোড় নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরাচারের
পতনে মুখ্য ভূমিকা নিলেন। অথচ ১৯৯১-এ গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যাপক
রিগিংয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনা আর তাঁর দল আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নিল
রাজাকার, বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আর সামরিক
স্বৈরশাসনের প্রেতাত্মাদের সমন্বয়ে গড়া দলটি। শেখ হাসিনা তাতে দমলেন না। জাতীয়
সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে যোগ দেয়ার পাশাপাশি রাজপথেও শুরু করলেন তীব্রতর
আন্দোলন। অবশেষে ১৯৯৬-এর ১২ জুন প্রায় একুশ বছর পর বাংলার মানুষ নেত্রী ও তাঁর
দলকে ক্ষমতার মসনদে বসাল। শেখ হাসিনা জনরায় পেলেন তাঁর দাবিগুলোকে বাস্তবে পরিণত
করার।
১৯৯৬ থেকে ২০২২-- এই ছাব্বিশ বছরের মধ্যে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন
প্রায় আঠারো বছর। জীবনের এই আঠারোটি বছর তাঁর কেটেছে মূলত দ্বিমুখী কর্মযজ্ঞে--
একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের, জাতির পিতা আর তাঁর পারিবারিক সদস্যদের হত্যাকারীদের ও
সন্ত্রাসি জঙ্গিদের বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা, এবং অন্যদিকে অসংখ্য
জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ ও প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতিকে শনৈ শনৈ
উন্নতির চরম শিখরে তুলে দেওয়া। উভয় কর্মযজ্ঞেই তিনি চ‚ড়ান্ত সাফল্যের স্বাক্ষর
রেখেছেন। দেশের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকল যুদ্ধাপরাধী, জাতির জনকের খুনি আর জঙ্গির
বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দণ্ড নিশ্চিত করেছেন, আবার উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়ে
দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন উন্নত দেশের কাতারে। শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে একটা শক্ত ভিত্তির
উপর দাঁড় করানোর পাশাপাশি জাতিকে দিয়েছেন একটা স্থিতিশীল এবং সত্যিকারের জনকল্যাণমুখী
সরকারের সুখকর অভিজ্ঞতা।
এই ছাব্বিশ বছরের মধ্যে যে আটটি বছর তিনি ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, তখন তাঁকে
ঠেকানোর, ব্যাহত করার, এমনকি তাঁকে হত্যা করার বার বার চেষ্টা চলানো হয়েছে।
একাধিকবার তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। ২০০৭-এ ক্ষমতায় আসা ফখরুল-মাইনুলের তত্ত্বাবধায়ক
সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে জেলেও পাঠিয়েছিল। তাঁকে হত্যার চেষ্টায় এরশাদ সরকারের আমলে
চট্টগ্রামে তাঁর উপর গুলি চালানো হয়, খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে ঢাকায় তাঁর উপর
ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। দুটো ঘটনা মিলে মৃত্যু হয় প্রায় পঞ্চাশ জনের,
আহত বা পঙ্গু হন আরো প্রায় চারশ মানুষ। এরা সবাই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর
নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষ। ঢাকায় নিহতদের মধ্যে ছিলেন বক্তৃতামঞ্চে বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পাশেই দাঁড়ানো তাঁর সহপাঠী বন্ধু, পরবর্তী কালের
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী, তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আইভি রহমান।
মঞ্চের একেবারে পাশেই একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দে শেখ হাসিনার একটা
কান বধির হয়ে যায়। দুটো ঘটনাতেই দলীয় নেতা-কর্মীরা মানবঢাল রচনা করে, এমনকি অনেকে
আঘাত নিজের উপর নিয়ে জখম বা মৃত্যুবরণ করেও। আরেকবার গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় আগে
থেকে মাটিতে পুঁতে রাখা একাধিক রিমোট কন্ট্রোল ভারী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বক্তৃতা
মঞ্চ উড়িয়ে দেয়ার মহাপরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তিনি এবং দলীয় আরো বহু নেতা-কর্মী
প্রাণে বেঁচে যান।
শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির জন্য যা করেছেন এবং বিনিময়ে এ জাতির কিছু
দুর্বৃত্ত তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে যা দিয়েছে, তার নির্মমতা আর নৃশংসতা সব
কল্পকাহিনিকেও হার মানায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের
অধিকাংশ সদস্যকে রাতের অন্ধকারে খুন করা হল, তখন খুনিচক্রের একান্ত দুর্ভাগ্য ছিল
যে, সে রাতে তারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু দেশে-বিদেশে তাঁকে
হত্যার জন্য পাগলা কুকুরের মতো তারা চেষ্টা করে গেছে বছরের পর বছর ধরে। তাঁকে
হত্যার ছোট-বড় চেষ্টা চালানো হয়েছে অন্তত ঊনিশ বার, বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে যখন
তাঁর কোনো প্রশিক্ষিত দেহরক্ষী ছিল না। অথচ প্রতিবারই খোদার অসীম কুদরত আর দলীয়
নেতা-কর্মী তথা সাধারণ মানুষের অপরিমেয় ভালোবাসা বর্ম হয়ে তাঁকে রক্ষা করেছে।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের সত্য আর ন্যায়বিচারের প্রতীক হয়েই তিনি যেন বেঁচে রয়ে
গেলেন পিতার আরব্ধ কর্ম সমাপনের জন্য, অপূর্ণ স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য। সংসদ
থেকে জাতিসংঘ, গণভবন থেকে রাজপথ-- প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি হয়ে উঠলেন জনকের যোগ্য
উত্তরাধিকারী তথা উত্তরসুরী।
নিজের যোগ্যতা, দূরদৃষ্টি আর কর্ম দিয়ে শেখ হাসিনা আজ এমন এক অবস্থানে পৌঁছে
গেছেন, যার বিস্তারিত বিবরণ কোনো ফিচারের সীমিত পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাঁর
সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনাপূর্ণ
দেশ, উন্নয়নের রোল মডেল। সাক্ষরতা, জনস্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বহু
ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ভারতের থেকেও এগিয়ে।
১৯৯৬-এ প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর প্রথম উদ্যোগ ছিল জাতির পিতার হত্যার বিচার
সম্পন্ন করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার। পরবর্তী পাঁচ বছরের শাসনামলে তিনি উন্নয়নের
প্লাবন বইয়ে দেন বাংলাদেশে, খাদ্যে ঘটিয়ে দেন এক অভূতপূর্ব বিপ্লব। শিক্ষার
উন্নয়নে তিনি ১২টি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
ভৈরব সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হয় এ আমলে, আর জাতির দীর্ঘলালিত স্বপ্ন
বাস্তবায়নে এ আমলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থাপন করছিলেন পদ্মা সেতুুর
নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর, সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে যে সেতুর নির্মাণ তার চলতি
শাসনামলে সম্পূর্ণ হয়ে জনগনের ব্যবহারের জন্যে উন্মুক্ত হয়েছে।
২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি নিরঙ্কুশ জনরায় নিয়ে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার মাত্র
দুমাসের মাথায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফলস (বিডিআর)-এর ৫৭ জন সামরিক অফিসারকে হত্যা
করে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখে তারা। কঠিন এক পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি অবস্থা
সামাল দেন। জাতির বহু মূল্যবান সন্তানকে হারানোর বেদনা নিয়েই তিনি আবারও শুরু করেন
জাতির সর্বতোমুখী উন্নয়নে তাঁর কঠিন সাধনা। খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য,
ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশকে পৌঁছে দিযেছেন এক
অভাবিতপূর্ব মাইলফলকে।
শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে যাত্রীপূর্ণ যানবাহনে পেট্রোল
বোমা নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে একের পর এক নৃশংস জঙ্গি
হামলা, বন্ধ্ হরতাল অবরোধ, গুমখুন প্রভৃতির মাধ্যমে স্বাধীনতার শত্রুরা দেশকে
জাহান্নাম বানিয়ে তুলেছিল। মমতাময়ী বঙ্গবন্ধুকন্যা এক্ষেত্রে সময়োচিত কঠোরতার
পরিচয় দিয়ে লৌহদৃঢ় হস্তে সব সন্ত্রাস সহিংসতাকে দমন করেছেন। যেসব যুদ্ধাপরাধী বা
স্বাধীনতা-বিরোধীর কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করার সাহস করবে না, তাদের কিছু হলে সারা
দেশে আগুন জ্বলে উঠবে বলে যারা মনে করত, তাদের ধারণ সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিপন্ন
করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, মিথ্যা কখনও সত্য হয় না, আর কেউই বিচার ও
দণ্ডের ঊর্ধ্বে নয়।
সকল সন্ত্রাস সহিংসতা ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে দুর্বার গতিতে বাংলার উন্নয়ন
ঘটছে। রাজধানীর মেট্রো রেল বা বাণিজ্যিক রাজধানীর কর্ণফুলি টানেলও এখন এক
প্রায়-বাস্তবায়িত স্বপ্ন। বাংলার মানুষ আজ আঠারো হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে
বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে, করোনা বিশ্বমারীকে পরাস্ত করে মুক্ত বাতাসে
নিশ্বাস নিচ্ছে যাঁর মমতাময়ী মাতৃতুল্য ভূমিকার সুবাদে, তাঁর নাম শেখ হাসিনা।
শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রথমে বিনামূল্যে স্কুল শিক্ষার্থীদের বই দিয়ে শুরু করলেও এখন
তারা খাবার, বৃত্তি এবং পোশাক পাচ্ছে। এখন ৫২টি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ, মাল্টিমিডিয়া দিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষার আধুনিকীকরণ
এবং উচ্চশিক্ষাকে গবেষণামুখী করতে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ চালু করেছেন তিনি।
তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে রূপান্তরের আরেক নাম শেখ হাসিনা। শেখ
হাসিনার বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ভিসার জন্য দাঁড়ালে এখন আর কোনো দেশের
দূতাবাস ফিরিয়ে দেয় না। উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশকে দেখতে আসে বিশ্ববাসী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তস্নাত পাহাড়ে অরণ্যে আজ শান্তি নেমেছে পাহাড়ি
বিদ্রোহীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পাদিত শান্তি চুক্তির হাত ধরে। পড়শি দেশ
মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী আজ বেঁচে থাকার আর ঘরে
ফেরার স্বপ্ন দেখছে শেখ হাসিনার ভরসায়। জাতীয় নেত্রী থেকে তিনি আজ পরিণত হয়েছেন বিশ্বনেত্রীতে।
শেখ হাসিনা প্রায়শ বলে থাকেন, “আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবের মেয়ে। আমি শাসক নই, মানুষের সেবক। জনগণের সেবা ও কল্যাণ করাটাকেই আমি সব
থেকে বড় কাজ বলে মনে করি। সেই ব্রত নিয়েই আমি কাজ করে যাচ্ছি।” তাঁর এ কথা কেবল মুখের কথা
নয়; জননেত্রী বা সরকার-প্রধান হিসাবে প্রতি পদে পদে তিনি এ কথার সত্যতা প্রমাণ করে
চলেছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনমুক্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তানি
শাসনমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত সুদীর্ঘ পঁচাত্তর বছরে শেখ হাসিনার সরকারের মতো
এত স্থিতিশীল আর সর্বতোমুখী নিবিড় উন্নয়নপ্রবণ সরকার বাঙালি জাতি আর দেখেনি।
করোনা বিশ্বমারী আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা
দেখা দিয়েছে, তার অবধারিত ছাপ পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। তেল গ্যাস বিদ্যুৎ
থেকে শুরু করে খাদ্যবস্তু ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে
সাধারণ মানুষ দিশেহারা। এই সঙ্কটকালে আবারও যথারীতি শক্ত হাতে রাশ ধরেছেন আমাদের
জাতীয় রথের সারথী শেখ হাসিনা। সাশ্রয়, কৃচ্ছতা, ভরতুকি, প্যাকেজ, প্রণোদনা প্রভৃতি
নান উপায়ে তিনি পরিস্থিতি সামার দেয়ার এবং জনদুর্ভোগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জোর
প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। করোনা বিশ্বমারী সঙ্কটের উত্তাল সাগর তিনি যেভাবে পাড়ি
দিয়েছেন, সাম্প্রতিক এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকেও তিনি অচিরেই জাতিকে উত্তীর্ণ করতে
পারবেন, আমাদের ষোল আনা সে-ভরসা আছে।
একজন যোগ্য জননেত্রী ও সফল সরকার-প্রধান হিসাবে শান্তি ও গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য বিমোচন, বহুমুখী উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে বিপুল অবদান
রেখেছেন,তার বহু স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন দেশে-বিদেশে। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক
আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে মাদার তেরেসা
পুরস্কার, মহাত্মা গান্ধি পুরস্কার, ইন্দিরা গান্ধি পুরস্কার প্রভৃতি। জাতিসংঘ ও
তার অঙ্গসংস্থাগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী উন্নয়ন প্রভৃতি সূচকে অবদানের জন্য
শেখ হাসিনাকে নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতিতে ভ‚ষিত করেছে। বিগত ২০১৮ সালে
সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘দা স্ট্যাটিস্টিক্স
ইন্টারন্যাশনাল’ পৃথিবীব্যাপী জরিপ চালিয়ে দক্ষ নেতৃত্ব, মানবিকতা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা বিচারে শেখ হাসিনাকে বিশ্বের দ্বিতীয়
সেরা প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি দেয়।
এ লেখার শুরুতে শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম ‘জননীর প্রতিনিধিস্থানীয়া’। তারপর বলেছিলাম একাধারে ‘জননী ও জনকের প্রতিনিধি’। এখন লেখার শেষপ্রান্তে এসে তাঁকে দিতে চাই ‘বিশ্বজননীর প্রতিনিধি’ অভিধা। কারণ তিনি শুধু
জাতিসংঘের ডায়াসে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনি বা সিরীয় অন্য যেকোনো দেশের লাঞ্ছিত নিপীড়িত
শরণার্থীদের প্রতি মানবিক সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করার মৌখিক আহ্বান জানিয়েই
ক্ষান্ত হননি, আজ প্রায় দেড়দশকেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহতভাবে প্রায় বারো লাখ
রোহিঙ্গা শরণার্থীকে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষা সবকিছুর যোগান দিয়ে বিশ্বমানবতার
প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন। তাঁর কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র বিশ্বের শরণার্থী, সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য যে মানবিকতা দেখিয়েছেন, তা বিশ্ববাসীর কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। এজন্যে আমাদের বলার আগেই অবশ্য বিশ্বদরবারে শেখ হাসিনা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বা ‘মানবতার মাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন, যার সূত্রপাত হয় হল্যান্ডের নামকরা সাময়িকী ‘ডিপ্লোম্যাট’-এর এক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘শেখ হাসিনা: মাদার অব হিউম্যানিটি’ থেকে।
আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মানবতার জননী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন। এই মহান নেত্রী শতবর্ষ
বেঁচে থেকে জাতিকে তথা বিশ্ববাসীকে শান্তি ও প্রগতির পথ দেখিয়ে যাবেন, এটাই আমাদের
একান্ত কামনা। প্রাচীন কবিদের স্বপ্নপূরণ করে বাংলা তথা বাঙালিকে “জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসনে” নিয়ে যাওয়ার শক্তি যদি কারো
থাকে, তা কেবল শেখ হাসিনারই আছে, এটাই আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
মন্তব্য করুন