১.
হিম নামছে হাড়ে,
হিম জমছে প্রাণে,
উষ্ণতা কি পেতে সবাই পারে?
সূর্যতপা হতে ক'জন জানে!
তোমার জানালা আলোয় ঝলোমল,
অগ্নিস্থলী আগুনে উজ্জ্বল।
বাইরে যেজন দাঁড়িয়ে অন্ধকারে
দেখো না তার অশ্রু টলমল।
হিমে ডুবুক অনন্ত তার রাত,
হিমার্ত হোক রক্ত-মজ্জা তার।
কোরো না তাতে করুণ দৃষ্টিপাত,
সুদূরে রাখো হিমেল অন্ধকার।
হিম নামছে, কুঁকড়ে যাচ্ছে সব।
নামুক-- তাতে না যেন থামে
তোমার উৎসব।
২.
একটি শিশিরবিন্দু এত বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে
ষাটোর্ধ শীতের আগে সে-খবর মানুষেরা জানতে পারে না।
একটি শুকনো পাতা ঝরে যায় এমন সরব হাহাকারে
গোধূলি জীবন শুধু মেনে নেয় তার কাছে সম্পর্কের দেনা।
কুয়াশা যখন নামে চরাচরে রহস্যের চাদর বিছিয়ে
বলিরেখাকীর্ণ মুখ সে-চাদরে ঢাকা যায় অন্তিম প্রহরে।
শীতের যথার্থ বার্তা তারই কাছে আসে শুধু অভিজ্ঞান নিয়ে
যে-জীবন যাত্রী হবে অপার দরিয়াগামী নাওয়ের বহরে।
গ্রীষ্মের উষ্ণতা কিংবা বসন্তের কবোষ্ণ পরশ কিছু নেই
বাকি আর, অন্তরঙ্গতার ফাঁদে পা রাখে না মিয়া কি মল্লার।
রঙ্গহীন ঋতুরঙ্গে গ্রীষ্ম বর্ষা শরত বসন্ত সবেতেই
লেগেছে শীতের ছোঁয়া, কুসুম কুসুম তাপ রোদে নেই আর।
এখন শীতার্ত দিন, এখন হিমেল রাত, বিবর্ণ সকাল
এখন একান্তে বসে শিশিরের শব্দাবলী গণনের কাল।
৩.
মানুষ তোমাকে ডাকছে না আর, পৃথিবীকে রাখো দূরে।
হে শঙ্খিনী, ডাকছে তোমাকে শীতনিদ্রার দিন—
ঢুকে যাও সেই আপন বিবরে, গোপন অন্তঃপুরে।
কী যেন ভাবতে ভাবতে তোমার দিন দিন তনুক্ষীণ!
মানুষ তোমাকে টানছে না আর, স্বজন কি হলো বৈরী?
সমাজ হলো কি শ্মশান তোমার, শাসন হলো কি স্বৈরী?
কুলকুণ্ডলে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালঘুমে পড়ো শুয়ে
এ ঘুম তোমায় নিদেনপক্ষে সব পেয়েছির স্বপ্নটুকু তো দেবে!
সেখানে তোমার নিজের ভুবন তোমার আঙুল ছুঁয়ে
চুম্বন করে তোমাকে বিপুল বিস্মরণের কৃষ্ণবিবরে নেবে।
ফের কোনোদিন আলো যদি জাগে, উষ্ণ হাওয়ার পাকে
জাগবে আবার শঙ্খিনী তুমি প্রাচীন সরীসৃপ,
নতুন খোলসে শরীরে জড়িয়ে নতুন মিলন ডাকে।
শূন্যবাদের সংসারে ফের গড়ে নেবে তুমি পূর্ণিমা ধোয়া দ্বীপ।
৪.
কাঁঁটাময় রুক্ষ কাষ্ঠল একটি গাছ
বুকে তার ক্ষত
ধারালো উজ্জ্বল রূপবতী
একটি ছেনি দিয়ে
সম্প্রতি খনিত।
বুকে দগদগে ক্ষত নিয়ে
গাছটি সটান দাঁড়িয়ে থাকে
তুহিন হিমেল শীতে
সারা রাত
কুয়াশাময় জোছনাপ্লাবিত প্রান্তরে
আর শিশির পতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
তার ক্ষত থেকে ঝরে পড়ে রাতভর
টুপটাপ টুপটাপ
শীতল শোণিত
মৃৎপাত্র ভরে ভরে
সে শোণিত পৌঁছে যায়
ভোরে ভোরে
ঘরে ঘরে...
প্রাকৃত নির্যাস ভেবে নিয়ে
মানুষ আকণ্ঠ পান করে
সে-শোণিত
বলে তাকে-- শীতের কবিতা...
৫.
হিমেল হাওয়ার ক্রমাগত দীর্ঘশ্বাসে কাঁপুনি লাগছে হাড়েমজ্জায়।
অসময়ের বৃষ্টিতে জবুথবু শীতের সন্ধ্যায়
নিবে আসছে পবিত্র আগুন।
আরো কিছু কাঠকুটো গুঁজে দিয়ে প্রাণপণে ফুঁ দাও
যাতে ফের লকলকিয়ে ওঠে লেলিহান অগ্নিশিখা।
শীতের শুকনো পাতা, খড়কুটোর সঙ্গে আগুনে আহুতি দাও
তোমার যত অপূর্ণ স্বপ্ন, মৃত ইচ্ছে, অধরা দুরাশা---
যাতে উত্তুরে হাওয়ার মুখ দক্ষিণে ফিরলেই
ফাল্গুনের বাসন্তী দাক্ষিণ্যের আশীর্বাদ
অন্তত শেষবারের জন্যে হলেও নেমে আসে তোমার উঠোনে।
যেদিন গেছে সে তো গেছেই—
হাতে গোণা বাকি কটা দিনে ভাগ্যে যেন দেখে যেতে পারো
আম্রশাখায় নতুন মুকুলের সমারোহ—
পার্থিব প্রাচুর্যের, পূর্ণতার শেষ সংবাদ।