‘ধানের দেশ, গানের দেশ বাংলাদেশ’ বলি কিংবা ‘গোলায় গোলায় ধান, গলায় গলায় গান’, বাংলাদেশ ও বাঙালি সম্পর্কে এগুলোর কোনটাই কথার কথা নয়। ইতিহাসের সূত্রে জানতে পারি, বাঙালির যাত্রা শুরু হয়েছে গান দিয়ে; বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাগীতিকা ছিল কতগুলো গান। মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি, বৈষ্ণব পদাবলী এমন কি য়ূসুফ জোলেখা, লায়লী মজনু ইত্যাদি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানসহ মধ্যযুগের সকল সাহিত্যকর্মই ছিল রাগতাল সমভিব্যবহারে গেয়। মধ্যযুগে অনেক সঙ্গীতঙ্গ কবি রাগতালনামা ধারার গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেগুলোতে রাগতালের ওপর শাস্ত্রীয় আলোচনা স্থান পেয়েছে। পদ্যের সঙ্গে সুরের সম্পর্ক এদেশে যে অবিচ্ছেদ্য আজকালকার নতুন পড়ণ্ডয়া শিশু কিশোররা যখন প্রথম পাঠ হিসেবে পাঠ্য কবিতা সুর করে পড়ে, তা থেকেই তা বেশ বোঝা যায়।
নন্দন সংস্কৃতির অন্যতম শাখা
হিসেবে সঙ্গীতের আদি রূপটি জন্ম নিয়েছিল খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠে। কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর অর্থাৎ আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ যারা উৎপাদনের
সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, সে সকল গ্রামীণ মানুষ দিনের কাজের ফাঁকে
কিংবা বছরের অবকাশকালীন সময়ে নিজেদের কিছুটা চাঙা করে নেয়ার ব্যবস্থা হিসেবে গান
করত। তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট তাদের গানের আদি রূপটিতে যথেষ্ট সরলতা সাবলীলতা থাকলেও
উৎকর্ষের ছাপ ছিল না। শাস্ত্রীয় উন্নতিসাধনের কাজ তাদের কাছ থেকে আশা করা বাতুলতা।
এই কাজটির জন্য ভিন্ন মেজাজের মানুষ প্রয়োজন। এই কাজটি করতে পারে নাগরিক চেতনা ও
উন্নত চিন্তাশক্তি সম্পন্ন, সত্যসন্ধ্যানী, বিজ্ঞানমনস্ক, ধীরস্থির মানুষ। তেমন মানুষও অবশ্য আমাদের
প্রাচীন সমাজে একেবারে দুর্লভ ছিল না। তাই লক্ষ্য করি সঙ্গীতের বেশ খানিকটা
বিকাশবিবর্তন সেই আদ্যিকালেই আমাদের এই বাংলাদেশেই সম্ভব হয়েছিল। অবশ্য তার কিছুটা
ছিল বহুমুখী মানবীয় মনীষার সূতিকাগার প্রাচীন আর্যসভ্যতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে
প্রাপ্ত।
সে যেভাবেই হোক, প্রাচীন বঙ্গদেশ যে একেবারে নিরক্ষর শিক্ষাদীক্ষাহীন
বর্বরের বসতি ছিল তেমন নয়। পণ্ডিতগণ পরীক্ষা করে মত দিয়েছেন চর্যাপদেও রয়েছে এক
প্রকারের নাগরিকতার ছোঁয়া। নগর মানে নানা অঞ্চলের নানা মানুষের সম্মিলনস্থল। নগর
মানে একটু বেশি ঘনত্বের মনুষ্যবসতি। নগর মানে মানুষে মানুষে একটু বেশি পরিমাণে
পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাববিনিময়, বেশি পরিমাণে
সামাজিকীকরণ। নগরে নাগরিক সমাবেশ ঘটেছিল ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। গ্রামের অর্থনীতি
পণ্য উৎপাদনেই সীমিত ছিল না। পণ্য সরবরাহ ও সঞ্চালনের উদ্দেশ্যে সে সময় কেউ কেউ
বেছে নিয়েছিল ব্যবসায় বৃত্তিও। ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠেছে গঞ্জ। সে সময়কার বাস্তবতায়
আকারে ক্ষুদ্র হলেও নগরের চাহিদা মিটিয়েছে এই গঞ্জই। একই রকমের নাগরিক আবহের যোগান
দিয়েছিল সে সময়কার বাংলার সামন্ত শাসকরাও। শাহ মুহাম্মদ সগীর, মুকুন্দরাম, মালাধর বসু, আলাওল, ভারতচন্দ্রসহ প্রায় সকল কবিই কোন না কোন রাজন্যবর্গের ছায়ায় তাঁদেরই সভাতলে
বসে তাঁদের কাব্যকর্মকে রূপ দিয়েছেন। (একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত বাউলরাই)।
লোকসঙ্গীত এইভাবে দিনে দিনে উৎকর্ষতা অর্জন করেও চরিত্রগতভাবে লোকসঙ্গীতই থেকে
যায়।
আমাদের দেশে দীর্ঘদিন লোকসঙ্গীত
ও লোকসাহিত্য হাত ধরাধরি করে চলেছিল। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে লিখিত নাগরিক সাহিত্য
একটু আগেভাগেই লোকসাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মধ্যযুগেই সম্ভবত বৈষ্ণবপদাবলীর
ব্যাপক সর্ববঙ্গীয় জনপ্রিয়তার প্রভাবে বাংলা ভাষায় একটি লেখ্য সাধু ভঙ্গী জন্ম
নেয়। চট্টগ্রামের মত প্রান্তিক অঞ্চলেও কবিরাও সাহিত্য রচনা করতে থাকেন সেই
সাধুরূপকে অবলম্বন করেই।
বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের
ধারাবাহিকতায় বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে ব্রিটিশ শিক্ষানীতির প্রভাবে। ১৮১৬
খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে ইংরেজি ভাষা ও ইউরোপীয় বিদ্যা
শিক্ষার বড় রকমের সুযোগ সম্প্রসারিত হয়। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাসচিব
লর্ড ব্যাবিংটন মেকলে ব্রিটিশ সরকারকে আমাদের দেশের একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে
ইংরেজি ভাষা ও ইউরোপীয় জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা সরকার গ্রহণ করেছিল। এর ফলাফলে আমাদের দেশের একটি
শ্রেণীর চিন্তা ভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন আসে। আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত শহরবাসী
জনসাধারণের মধ্যে এদেশের যাবতীয় লৌকিক ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞার ভাব জন্ম নেয় এবং
ইংরেজি ভাষা সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় বিদ্যা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের
সাহিত্যের আঙ্গিকেও ইউরোপীয় সাহিত্য আঙ্গিকের ব্যাপক অনুসৃতি ঘটে। সাহিত্যের
পাশাপাশি সঙ্গীতও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। ১৯২৫ সালের দিকে গ্রামোফোন রেকর্ডের
মাধ্যমে সঙ্গীত ধারণ করে বাণিজ্যিকভাবে প্রচারের ব্যাপারটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ
করলে আমাদের সঙ্গীতের ধারায় তার প্রভাব পরিস্ফুট হয়। ইতোমধ্যে প্রধানত রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ পঞ্চকবির (অপর তিনজন হচ্ছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন) কাব্যসঙ্গীতের সাধনার
ফলে আধুনিক বাংলা গানের একটি নতুন সংগঠন দাঁড়িয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের
লোকসঙ্গীত থেকে বাংলা সঙ্গীত একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে তদানীন্তন
ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায় সমাবিষ্ট হওয়া উত্তর ভারতীয় ঘরানার মুসলিম
সঙ্গীতবিশারদদেরও একটা ভূমিকা ছিল। বিশেষভাবে সঙ্গীতে উত্তর ভারতীয় ঘরানার
ভাবধারার ভক্ত অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন গীতিকার সুরকার কাজী নজরুলের অবদানও নেহাত
কম ছিল না।
ইউরোপে উনিশ শতকের শেষ দশক
নাগাদ জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার (১৮২৩-১৯০০), ফরাসি লেখক জাঁ ক্রিশতফ খ্যাত রোমা রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪), মরিস মেটারলিঙ্ক (১৮৬২-১৯৪৯) প্রমুখ ইউরোপীয় দার্শনিক লেখক
ঐতিহ্যবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার ঢেউ এসে ঠেকেছিল বাংলাদেশের তটেও। ড. দীনেশ
সেন,
রবীন্দ্রনাথ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ পুরোভাগে থেকে এই আন্দোলনকে বাংলায় রূপ দিয়েছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুঁথি সংগ্রহের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল এবং অর্থ বরাদ্দ
দিয়েছিল। এই বঙ্গে চন্দ্রকুমার দে প্রমুখের চেষ্টায় সংগৃহীত হয়েছিল ময়মনসিংহ
গীতিকা। পল্লীকবি জসিম উদ্দীন প্রচুর পল্লী গীতিকা সংগ্রহ করেছিলেন ড. দীনেশ
সেনের সঙ্গে থেকে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোন পক্ষের কোন প্রকার আর্থিক সাহায্য
ছাড়াই নিজ উদ্যোগে এই অঞ্চল থেকে প্রচুর হস্তলিখিত পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন।
চট্টগ্রামের আশুতোষ চৌধুরী এবং কবি ওহীদুল আলমও প্রচুর লোকগান সংগ্রহ করলেন।
এইভাবে বাংলার লোকগান ভদ্রলোকের আসরে আবার পাত্তা পেতে শুরু করল। তখন এর নাম
পল্লীগীতি হয়ে যায়।
আমাদের জানা মতে, পল্লীগীতি বিগত শতকের দ্বিতীয় দশকে গ্রামোফোন রেকর্ড হতে
শুরু করেছিল এবং এ ব্যাপারে আব্বাস উদ্দিন এবং কাজী নজরুল ইসলামের একটি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান ছিল। লোক সঙ্গীতকে আধুনিক যুগে গ্রহণযোগ্য করে তোলার
ব্যাপারে কুমিল্লার শচীন দেব বর্মনের ভূমিকাও ছিল অসামান্য। তিনি বাংলার লোকগানের
সুরকে পরবর্তীকালে বোম্বের সিনেমায়ও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে একে সর্বভারতীয়
জনপ্রিয়তা দানের ব্যাপারেও যথেষ্ট বড় অবদান রেখেছিলেন। সিলেটের নির্মলেন্দু চৌধুরী
বাংলার লোকসঙ্গীতের আর এক মহান শিল্পী। তবু এটা বলতেই হয় যে, বিগত শতকের চল্লিশ দশক থেকে পরবর্তী কয়েক দশক আকাশবাণী
কলকাতাকে কেন্দ্র করে ভারতের কলকাতায় নাগরিক রুচির তথা ‘আধুনিক’ সঙ্গীতের যে চর্চা
হয়েছে,
জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জি, শ্যামল মিত্র, গীতা দত্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, গায়ত্রী বসু প্রমুখ প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অমর সুরকার বাংলা গানের যে স্বর্ণযুগ রচনা করেছিলেন, তার তুলনায় বাংলা লোকগান ততটা গুরুত্ব পায় নাই। তবে এই
অভাবটি পূরণ করেছিল, ভারতবিভাগের পরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান
তথা আজকের এই বাংলাদেশ। বিভাগপরবর্তীকালে কলকাতা থেকে পল্লী সঙ্গীত সম্রাট
আব্বাসউদ্দিন এই বাংলায় চলে এসেছিলেন। মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ আধুনিক শিক্ষায়
পশ্চাদপদ হওয়ায় কলকাতার ধাচের নাগরিক সঙ্গীতের প্রসার এই বঙ্গে বিশেষ একটা হয় নাই।
অনেকটা সেই জন্যেই হয়তো যে সকল প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী ঢাকা বেতারকেন্দ্রের
অনুষ্ঠান সাজাবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তাঁদেরকে এই বঙ্গের লোকগানের আশ্রয়ই নিতে হয়েছিল। আব্বাস উদ্দিন ১৯৫৯ সালে
পরলোকগমন করেছিলেন। তাঁর মশাল তুলে ধরেছিলেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা ফেরদৌসী বেগম এবং
পুত্র মোস্তফা জামান আব্বাসি। মুর্শিদাবাদ থেকে অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী লোকগানের
কিংবদন্তী প্রতিভা নিয়ে তরুণ বয়সে এদেশে এসেছিলেন আবদুল আলীম। জসিম উদ্দিন প্রচুর
লোকগান সংগ্রহ করেছিলেন এবং রচনাও করেছিলেন। বিখ্যাত দোতারা বাদক কানাইলাল শীল
প্রচুর গানে সুর দিয়েছিলেন। যুগপৎ গান লিখেছেন, সুর করেছেন, কণ্ঠ দিয়েছেন এরকম আরো বহু লোকগীতি শিল্পী পর
পর আবির্ভূত হলেন এই বাংলায়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল লতিফ, মমতাজ আলী খান, আবদুল হালিম চৌধুরী, বেদারউদ্দিন আহমদ, নীনা হামিদ, ওসমান আলী খাঁ, নাদিরা বেগম, মাহবুবা রহমান, ফরিদা পারভিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এই সময় এই
বাংলায় যে সকল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল সে সকল চলচ্চিত্রেও লোকগানের ব্যবহার
হয়েছে প্রভুত পরিমাণে। যে সকল প্রতিভাবান সঙ্গীত পরিচালক তাঁদের পরিচালিত
চলচ্চিত্রে বাংলার লোকগানকে ও সুরকে ব্যবহার করেছেন তাঁদের মধ্যে খান আতাউর রহমান, ধীর আলী মনসুর, রবীন ঘোষ, আবদুল লতিফ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সকলের
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বঙ্গে বাংলা লোকগানের কিংবা পল্লীগীতির ব্যাপক চর্চা হয়েছে
বলা যায়। তবে স্বাধীনতার পরে এখানেও বাংলা লোকগানের চর্চায় কিছুটা ভাটা পড়ে। এখানে
বর্তমানে পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রানুষঙ্গে ব্যান্ড সঙ্গীত নামে নতুন এক ধরনের গান ও
গায়নরীতি চলছে, অনেক নবীন উদ্যমী সঙ্গীতশিল্পী এই ধারার
সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, যদিও ব্যান্ড ধাঁচের অনেকে আমাদের বাংলাদেশের
লোকগানের ঐতিহ্যকে একেবারে বিস্মৃত হন নি। তবে আজও লোকগানকে অপরিসীম ভালবাসায় ধরে
রেখেছেন আবদুর রহমান বয়াতী, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, মিনা বড়ণ্ডয়া, কিরণশঙ্কর, মমতাজ, সুফিয়া প্রমুখ।
বাংলা লোকগানে চট্টগ্রামের
বিরাট এক ঐতিহ্য রয়েছে। চট্টগ্রামের আশুতোষ চৌধুরী এবং কবি ওহিদুল আলমের লোকসঙ্গীত
(এবং লোক সাহিত্য) উদ্ধারের প্রয়াসের কথা আগে উল্লেখ করেছি। ওহীদুল আলমের সংগ্রহ
তাঁর সম্পাদিত ‘পূরবী’ পত্রিকায় এবং ‘চট্টলগীতিকা’ নামে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়
প্রকাশিত হয়েছিল। পরে আরো নতুন কিছু সংগ্রহ নিয়ে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়
তাঁর ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ গ্রন্থ। তিনি তাঁর এ বইয়ে নুরুল ইসলাম চৌধুরী রচিত
চট্টগ্রামের ‘ লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থের সংগ্রহও ব্যবহার করেছিলেন বলে
উল্লেখ করেছিলেন। ড. দীনেশ সেনের অন্যতম সহযোগী সংগ্রাহক হিসেবে আশুতোষ চৌধুরী বহু
কষ্ট পরিশ্রম স্বীকার করে চট্টগ্রাম এবং তৎপার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে প্রচলিত
অনেকগুলো পালা গান সে সময়কার জনপ্রিয় পালাকারগণের নিকট থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তাঁর
সংগৃহীত পালাগান ‘পূর্ববঙ্গগীতিকা’র কয়েকটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুইজনের
উদ্যোগেই এ সময়কার জনপ্রিয় কিছু লোকগান গ্রামোফোন রেকর্ডে ধারণ করা হয়েছিল। রেকর্ড
করেছিলেন চট্টগ্রামের সমকালীন দু’জন সুকণ্ঠ গায়ক মোহাম্মদ নাসির এবং মোহাম্মদ
হারুন। এ দু’জনের গানের রেকর্ডের মাধ্যমেই আধুনিক রেকর্ড যুগে চট্টগ্রামের
লোকগানের যাত্রা শুরু। সে সকল এবং আমাদের কিছু সংগ্রহ পর্যালোচনা করে আমরা
চট্টগ্রামে লোকসঙ্গীতের কয়েকটি ধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করতে পারি। সেগুলো হচ্ছে
যেমন ক) প্রেমসঙ্গীত; খ) বিয়ে হঁঅলা বা মেয়েলি গান; গ) মারফতি গান; ঘ) কবি গান; ঙ) জারি গান বা মহরম সঙ্গীত; চ) উজ্জীবনীসঙ্গীত; ছ) গাইনের পালা বা গাজীর গান ; জ) পুস্তিকা কবিতা। চট্টগ্রামের এ সকল গানকে অনেকে আঞ্চলিক গানও বলে থাকেন।
(কল্যাণী ঘোষের সংকলনগ্রন্থ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান স্মর্তব্য)। একজন বিশেষ
গীতিকার যখন একটি গান রচনা করে থাকেন, তখন তাকে লোকগীতি বলা সঙ্গত কতখানি হবে, এ প্রশ্নটি সামাল দিতেই সম্ভবত চট্টগ্রামের লোকগানকে আঞ্চলিক গান বলা হয়েছে।
তবে এটা ঠিক যে আঞ্চলিক তথা লোকভাষায় রচিত হলে একটি গানে প্রচুর লোক উপাদান
অনিবার্যভাবেই থাকে।
গানের একটি বিশিষ্ট সুর আছে।
সুর শুনে যেমন কোনটি আধুনিক কোনটি পল্লীগীতি সহজেই বোঝা যায়, ঠিক তেমনি সুর দিয়েই পদ্মাপাড়ের গান থেকে হালদা কর্ণফুলীর
তীরের মানুষের গানকে আলাদা করা কোন কঠিন কাজ নয়। ওহীদুল আলম তাঁর ‘চট্টগ্রামের
লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে একটি গানের উল্লেখ করে (ভইনের বানারসি শাড়ি গায়/ আনা ধরি সিতা
পারের ভইনে/ পান চাবাই চাবাই।) বলেছিলেন, এই গানটিতেই চট্টগ্রামের সেই বিশেষ সুরটি সবচাইতে বেশি আছে। ওহীদুল আলম আজ আর
আমাদের মধ্যে নেই। তা সত্বেও চট্টগ্রামের লোক সহজবুদ্ধিতে এই গানটির সুর ঠিক কী
রকম ছিল অনুমান করে নিতে পারে। কারণ চট্টগ্রামের গানে এই সুরটি বার বার আসে।
পরলোকগত আশুতোষ চৌধুরী এবং ওহীদুল আলমের তত্ত্বাবধানে মোহাম্মদ হারুন, মোহাম্মদ নাসির প্রমুখ কর্তৃক গ্রামোফোন রেকর্ডে যে সকল গান
ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদ হারুন কর্তৃক
রেকর্ডকৃত ‘গরবা বুঝাইন্যা মাছ, মেলা চুবাইন্যা মাছ, রাঁধুনি চতুর রে মাছ ইলিশারে’, ‘রঙ্গুমরঙ্গিলার সনে মজি রইল মন’, মলকাবানুর হঁঅলা এবং মোহাম্মদ নাসিরের ‘মনপাখিরে বুঝাইলে সে
রে বুঝে না’ এবং ‘চানমুখে মধুর হাসি, দেবাইল্যা বানাইল মোরে সাম্পানের মাঝি’-।
বহু প্রতিভাবান কবি/ কবিয়াল, গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক
দীর্ঘকাল থেকে চট্টগ্রামের এ সকল আঞ্চলিক গান রচনা করেছেন ও করছেন। প্রথমে কবিয়াল
রমেশ শীলের (১৮৭৭-১৯৬৭) নাম উল্লেখ করতে হয়। বোয়ালখালী গোমদণ্ডীর রমেশ শীল অত্যন্ত
সমাজ ও রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ অবলম্বনে প্রচুর গান ও
কবিতা রচনা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে রাজনৈতিক গান রচনার জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে
হয়েছিল। তাঁর অসামান্য কীর্তি হচ্ছে অসংখ্য মাইজভাণ্ডারী গান রচনা। হিন্দু মুসলমান
সকল মাইজভাণ্ডার ভক্ত চাটগাঁবাসী তাঁর এ সকল মাইজভাণ্ডারী গান গেয়ে থাকেন। ‘আমার
সাম্পান যাবে উজানে/ কে যাবিরে আয়রে তোরা আঁর হাউসের সাম্পানে’, ‘নাতিন বরই খাঁ ইত্যাদি তাঁর বহু গান আজও জনপ্রিয়। মোহাম্মদ
নাসিরের (১৯০৩-১৯৭৯) প্রসঙ্গ আগে উল্লেখ করা হয়েছে। গান রচনা, সুরারোপ এবং দরাজ দরদী কণ্ঠে উপস্থাপন সকল ক্ষেত্রে তাঁর
সমান দক্ষতা ছিল। ১৯৩২ সালে রেকর্ডকৃত উল্লেখিত গানগুলো ছাড়াও পরে রেকর্ডকৃত তাঁর
বহু গান এক সময়ে মাইকে নিয়মিত বাজত। বিশিষ্ট কবিয়াল রাউজানের কবি ফনী বড়ণ্ডয়া
(১৯১৫-২০০২) কিছু আঞ্চলিক গানও রচনা করেছিলেন। রমেশ শীলের শিষ্য ফনী বড়ণ্ডয়াও
যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং মার্ক্সবাদী দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাঁর
লেখা ‘পোয়া কাঁদের ভাতরলাই/ আটা কিনতাম পয়সা নাই’ গানটি তাঁর চিন্তাধারাকে
প্রতিফলিত করে। রাউজানের নোয়াপাড়ার মলয়ঘোষ দস্তিদার ( ১৯২০-১৯৮২) ‘ছোড ছোড ঢেউ
তুলি’ এবং ‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান’ গ্রামোফোন রেকর্ডে এই গান দুটি বেরুলে তাঁর
নাম অতি অল্প সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তিনি আরো বহু গান গেয়েছেন
কিন্তু এই গান দুটো তাঁকে যতটা খ্যাতি দিয়েছে, আর কোন গান তেমনটা পারে নি। তাঁর উল্লেখিত গান দুটোর তাৎপর্য এখানে যে দুটো
গানই লেখা হয়েছিল আগাগোড়া চট্টগ্রামী ভাষায় এবং এ দুটোতে চট্টগ্রামের গানের
ঐতিহ্যবাহী সুরটি বিধৃত ছিল। গান দুটো প্রকাশিত হবার পর চট্টগ্রামী ভাষায় গান
রচনায় চট্টগ্রামের কবি গীতিকাররা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত বোধ করেন। অচিন্ত্যকুমার
চক্রবর্তী (১৯২৬-১৯৯৪) পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রামের প্রগতিশীল আন্দোলনে ও কর্মকাণ্ডে
নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচুর
গান লিখেছিলেন এবং সেগুলো মঞ্চে নিজে পরিবেশন করতেন। তাঁর গানগুলোর মধ্যে রয়েছে
‘গুরা বউ বউরে হন্ধ্যাকালে চেরাগ দিত গেল্’, ‘সূর্য উডের লাল মারি, রইস্যা বন্ধু ছাড়ি গেলগৈ বুকত ছেল মারি’
ইত্যাদি আজো জনপ্রিয়। ফটিকছড়ির অধিবাসী মোহনলাল দাশ (১৯২৬-১৯৭৪) ছিলেন একাধারে
গীতিকার এবং সুরকার।
তাঁর রচিত ‘ওরে সাম্পানওয়ালা
তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর অন্যতম। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব
(১৯২৭-২০০০) ব্যক্তিগত জীবনে সাধক ছিলেন। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম বেতার থেকে
অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তীর লেখা তাঁর গাওয়া ‘গুরা বউ বউরে’ গানটি প্রচার হলে তিনি
ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। পরে হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে তাঁর আর একটি গান ‘চল অপুত
বিলত যাই’ সহ রেকর্ড বের করে। শেফালি ঘোষের সঙ্গে জুটি বেঁধে প্রচুর দ্বৈতগানে
তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের এ জুটি দেশে বিদেশে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন
করেছিল। প্রাণবন্ত ও সপ্রতিভ ভঙ্গিতে সঙ্গীত পরিবেশনের তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।
খ্যাতিমান কবিয়াল ইয়াকুব আলী (১৯৩১-?) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বেশ কিছু গানই রচনা করেন নি, তিনি এগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশও করেছিলেন। ‘চট্টগ্রামের
আঞ্চলিক ভাষায় পল্লীগীতি’ এবং ‘চাটগাঁয়ের আঞ্চলিক গান’ তাঁর দুটো গ্রন্থের নাম।
রাউজানের এম. এন. আখতার (১৯৩১) প্রধানত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। তবে শেফালি ঘোষের
সংস্পর্শে তিনি বেশ কিছু আঞ্চলিক গানও রচনা করেন। ‘ও ছোড দেওরা ভাই, আলগা কথা ন কইও আর’, ‘ও পরানর তালত ভাই, চিডি দিলাম পত্র দিলাম’, ‘বরই ফুলের থামি’ যদি সোন্দর একখান মুখ পাইতাম’ ইত্যাদি তাঁর
বহু জনপ্রিয় গানের কয়েকটি। পটিয়ার শোভনদণ্ডীর বাসিন্দা আবদুল গফুর হালী (১৯৩৬)
একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী। তিনি ১৯৫৫ সালের দিকে গান
লেখা শুরু করেন। তাঁর রচিত আঞ্চলিক গানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। ১৯৬৩ সাল থেকে
তিনি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন। উল্লেখ্য, জার্মান গবেষক ড. হ্যান্স হার্ডার আবদুল গফুর হালীকে নিয়ে
একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়াও তথ্যচিত্র নির্মাতা শৈবাল চৌধুরী তাঁকে
নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে, সুরকার ও শিল্পীর
প্রতি অসাধারণ দায়িত্ব পালন করেন। শেফালি ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব থেকে চট্টগ্রামের অনেক শিল্পীই তাঁর গান গেয়েছেন এবং
রেকর্ড করেছেন। ক্যাসেটে এবং গ্রামোফোন রেকর্ডে তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ
শতাধিক। চট্টগ্রামী ভাষায় তিনি অনেকগুলো নাটকও রচনা করেছেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য
নাটকগুলো হল- গুলবাহার, নীলমণি, আশেক বন্ধু, আজব সুন্দরী ইত্যাদি। ‘ ও শ্যাম রেঙ্গুন ন
যাইয়ো’,
‘ ছোড কাইল্যা পিরিত আঁর’, ‘ওরে বন্ধু ন গরিস ছারকার’, ‘রসিক তেল কাজলা, ঐ লাল কোর্তাওয়ালা’, ‘রিকসা চালাও রসিক বন্ধু’, ‘ সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ ইত্যাদি তাঁর কিছু জনপ্রিয় গান।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী স্বনামখ্যাত প্রয়াত শিল্পী শেফালি ঘোষ
(১৯৪৪-২০০৬) চট্টগ্রামের গানকে আশ্চর্য এক মর্যাদা দিয়েছেন নিজের অসাধারণ
কণ্ঠমাধুর্য এবং ভালবাসা দিয়ে। প্রাথমিক জীবনে উচ্চাঙ্গ এবং নজরুল সঙ্গীতে তালিম
নিয়েছিলেন। এক সময় চট্টগ্রাম বেতারে আধুনিক গান পরিবেশন করতেন। চট্টগ্রাম বেতারের
আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফুজ্জামানের সহযোগিতায় শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সঙ্গে মলয় ঘোষ
দস্তিদারের রচিত ‘নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি’ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে গেয়ে বিপুল
জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম’ গানটি গেয়ে তিনি
সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন। সেই থেকে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। তাঁর
চল্লিশটির অধিক আঞ্চলিক গানের ক্যাসেট রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বহুদেশে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সঙ্গীতশিল্পী শেফালি ঘোষের সবচাইতে বেশি
গৌরব এখানে যে তিনি চট্টগ্রামের বাইরের শ্রোতাদের মধ্যে পরিচিত। তাঁর গানের সুবাদে
চট্টগ্রামী ভাষার প্রতি অচট্টগ্রামীদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এই ভাষার
প্রতি অন্য অঞ্চলের অনেক উন্মাসিক মানুষের শ্রদ্ধাবোধ জেগেছে। নানা গীতিকারের ও
সুরকারের গান তাঁর সুললিত কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে ওঠেছে। সৈয়দ মহিউদ্দিন (১৯৫৩) মহিয়াল
ভাণ্ডারী নামেও সুপরিচিত। তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় প্রচুর গান রচনা করেছেন।
চট্টগ্রামের শব্দ, শব্দবন্ধ তথা চট্টগ্রামের সামগ্রিক সংস্কৃতি
তাঁর গানে সাবলীলভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। ‘অ জেডা ফইরার বাপ’ তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয়
একটি গান। সনজিত আচার্য্য (১৯৫৩) চট্টগ্রামী বাংলায় প্রচুর গান রচনা করেছেন। তাঁর
গানের ক্যাসেটের সংখ্যা পনেরোটির অধিক। তিনি সাম্পানওয়ালা নামে একটি নাটকও রচনা
করেছেন। অজিতবরণ শর্মা (১৯৫৫) পেশাগতভাবে অধ্যাপক। তাঁর ‘শর্মার আঞ্চলিক গান’ একটি
গানের সংকলন আছে। এছাড়া কিছু গীতিকার গায়ক সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু জানতে পারি নি।
এঁদের মধ্যে আসকর আলী পণ্ডিতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর অসামান্য একটি
লোকজ ভাবের গান ‘ডালেতে লরিচরি বইও চাতকি ময়নারে’ গায়ক তপন চৌধুরীর কণ্ঠে বিপুল
জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দ্বিজেন ঘোষ নামে একজন গায়কের একটি গান ‘বাপের বাড়ি ছাড়িয়ারে
কন্যা শ্বশুর বাড়ি যায়’ বিখ্যাত গায়ক মলয় ঘোষ দস্তিদারের প্রায় সমসাময়িককালে বিপুল
জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যতদূর জানা যায়, তিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিলেন। নবীনদের মধ্যে স্বপন কুমার দাশ, ইকবাল হায়দার, এম. এন. আলম, উমা খান, কাজল দাশ, খাইরুজ্জামান, দীপক আচার্য, বাবুল আচার্য, শফি সুমন প্রমুখ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিশীল।
চট্টগ্রামের গীতিকার, সুরকার ও গায়কগণ সবাই চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে আজন্মলালিত। চট্টগ্রামের আলো বাতাস তাঁদের চিরচেনা। তাই প্রাণের তাগিদে সাবলীল প্রাণবন্ত ভাষায় গান রচনা ও সুর করা তাঁদের জন্য কঠিন নয়, বরং অন্তরের নিখাদ আবেগের সাবলীল স্ফূর্তির মাধ্যমে ঘটে বলে তাঁরা এক অনির্বচনীয় সৃষ্টির অলৌকিক আনন্দের ছোঁয়া পান। যে সকল গায়ক, সুরকার এবং গীতিকার এই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে তাঁদের শিল্পীসত্তাকে ফুটিয়ে তুলছেন, এটা তাদের নিকট আশ্চর্য এক নেশা। এ নেশা কখনো ছুটবে না। তাঁরা চিরঞ্জীব হোন। তাঁদের জন্য আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।