এবারের
৫২তম বিজয় দিবস এসেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে। আগামী বছর, অর্থাৎ
২০২৩-এর শেষদিকে বা তার পরের বছর ২০২৪-এর শুরুর দিকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয়ে গেছে। দলীয় প্রার্থীদের
নাম এখনও ঘোষণা করা হয়নি, কিন্তু জনসমাবেশের নামে বিভিন্ন দল নিজেদের জনপ্রিয়তার কড়া
শোডাউন চালাচ্ছে।
ভাবসাব
দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এবার
ক্ষমতায় আসার জন্যে একেবারে মরীয়া। যেনতেন প্রকারে তক্ত দখলের জন্যে তারা যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা চাইছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার আবারো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা
দিয়ে পদত্যাগ করুক, এবং সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
স্মর্তব্য,
প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটার পর, ১৯৯০-এ আওয়ামী লীগ
ও বিএনপি-সহ সকল রাজনৈতিক দলের সম্মতিক্রমে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
চালু করা হয়েছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যায় পক্ষপাতিত্বসহ নানা অপ্রিয় অভিজ্ঞতা,
বিশেষ করে ২০০৭-এর তত্ত্বাবধায়ক ফখরুল-মাইনুল সরকারের তিনমাসের জায়গায় দুবছর ক্ষমতায়
থেকে যাওয়া আর ক্ষমতার বহু অপব্যবহারের নজির সৃষ্টির পর, ২০০৯-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে
ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে বিল পাস
করিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। সেইসাথে নির্বাচনে সুষ্ঠতা নিশ্চিত
করার জন্যে নির্বাচন কমিশনকে উত্তরোত্তর শক্তিশালী করা হয়ে চলেছে।
কিন্তু
বিএনপি আর তার জোটভুক্ত স্যাঙাত দলগুলোর এটা ঠিক মনপসন্দ্ হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন সরকারের
পদত্যাগ আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে তারা ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করেই চলেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালের সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে একই দাবিতে আন্দোলনের
নামে তারা দেশে কী অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিউজ পোর্টালে
এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে: “২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কয়েক
ধাপে দেশ জুড়ে জ্বালাও-পোড়াও, চলন্ত যানবাহনে পেট্রোল বোমা হামলা, সড়কে ককটেল ও হাতবোমা
বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
যানবাহন চালক, দিনমজুর, কর্মীজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী-শিশুসহ সহস্রাধিক মানুষকে
নির্বিচারে হত্যা করে তারা। পুড়িয়ে দেয় কয়েক হাজার বাস-ট্রাক। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের
শিক্ষাঙ্গণ, কৃষিক্ষেত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমদানি-রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত
হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ওপর প্রভাব পড়ে।”
২০১৫’র ২৩ জানুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার
এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হরতাল-অবরোধের নামে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে
গড়ে প্রতিদিন রাে ষ্ট্রর ২,২৭৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতির পরিমাণ পরে আরো বেড়ে
গিয়ে গড়ে দৈনিক আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। নাশকতার প্রথম ১৬ দিনে ক্ষতির পরিমাণ
ছিল ৩৬,৪৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা বছরের দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩ শতাংশ।
একাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০১৭-১৮ সালেও তারা অনুরূপ নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা
করলেও, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার্থে দৃঢ় হাতে
তা দমন করেন। ইত্যবসরে, আদালত জিয়া এতিমখানা মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, একুশে আগস্ট
গ্রেনেড হামলার মামলা প্রভৃতিতে মা-ছেলের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে। এর মধ্যে মা কিছুদিন
জেলে থাকার পর শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে প্রধানমন্ত্রী দয়াপরবশ হয়ে তাকে স্বগৃহে
অন্তরীণ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে, বিএনপি’র আগামীর আশাভরসাস্থল, দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি তারেক
জিয়া প্রায় এক দশক ধরে বিদেশে পলাতক জীবনযাপনের পাশাপাশি নানা ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নেড়ে
চলেছে। দেশে ফিরলে বাকি জীবন তাকে জেলের ভাতই খেতে হবে।
প্রচলিত
আইন অনুযায়ী দণ্ডিত আসামি হওয়ায় স্বভাবতই এরা দুজন নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না।
স্বভাবতই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন তুলেছেন, যে-দলের প্রধান আর উপপ্রধান
দুজনেই দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি, শীর্ষনেতাদের অনেকেই জেল খাটছেন, কেউ কেউ ফাঁসির দিন
গুণছেন, তাদের নির্বাচনে যাওয়ার যোগ্যতা বা সামর্থ্য কতটুকু। সঙ্গত কারণেই আগামী নির্বাচনের
আগে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,
“কাদের সঙ্গে সংলাপ? হত্যাকারী,
দুর্নীতিবাজ, গ্রেনেড হামলাকারী খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের সঙ্গে?”
বিএনপিকে
কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছেন, বিএনপির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,
“আপনারা আন্দোলন করেন, মিছিল করেন,
মিটিং করেন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি ওই মানুষ পুড়িয়ে মারা বা বোমা মারা বা গ্রেনেড মারা
বা মানুষকে অত্যাচার করতে যান, তাহলে একটাকেও ছাড়ব না। এটাই হলো বাস্তবতা। ’
বিএনপির
সঙ্গে সংলাপের পরামর্শদাতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া দুর্নীতিবাজ,
গ্রেনেড হামলাকারী, আইভি রহমানের হত্যাকারী, আর জিয়া ছিল আমার বাবার হত্যাকারী। আর
এদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে? আলোচনা করতে হবে? আবার মানবাধিকারের কথাও বলে! এটা কেমন
ধরনের কথা, সেটাই আমি জিজ্ঞেস করি।”
তিনি
বলেছেন, “বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে,
নির্বাচন কমিশন আছে। যারা নির্বাচন করার করবে। আর কারো নির্বাচন করার শক্তি যদি না
থাকে তাহলে করবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা ভোট করবে, আর
কেউ ভোট চুরি করলে বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেয় না। খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে ভোট চুরি করেছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে টেনে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছিল।”
বিএনপির
সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমাদের ওপরে যে আঘাত দেওয়া হয়েছে আমরা তা ভুলি নাই। আমরা
সহ্য করেছি দেখে যেন এটা মনে না করে যে সহ্য করাটা আমাদের দুর্বলতা। দুর্বলতা না। বাংলাদেশের
জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে, আমাদের সঙ্গে আছে। ওই খুনিদের সঙ্গে নাই। জিয়া খুনি,
খালেদা খুনি, তারেক জিয়া খুনি। শুধু খুনি না, অর্থ পাচারকারী, অস্ত্র পাচারকারী, মানুষ
হত্যাকারী। ওদের কী অধিকার আছে এ দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বা মানুষের ভোট চাওয়ার
বা রাজনীতি করার?”
বিভিন্ন
উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর রাখা এসব বক্তব্যের প্রতিটি পয়েন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর
মধ্যে দিয়ে বিএনপি’র থলের বহু বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে।
কিন্তু তাদের থলেতে লুকানো এত বেশি বেড়াল আছে যে, বের হতে হতেও শেষ হবে না। ওদের রাজনীতি
সত্যিই প্রশ্নসাপেক্ষ। জোর করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী একজন খুনি জেনারেলের
পকেট থেকে বেরুনো এ দল আদৌ কোনো রাজনৈতিক দল কিনা, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। একের
পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত না হলে, সুস্থ রাজনীতির চর্চা অব্যাহত রাখতে পারলে,
স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বিএনপি’র মতো দলের উদ্ভবই হতে পারতো কিনা, সন্দেহ আছে।
দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবারের বিজয় দিবসে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ
এবং স্বাধীনতার মূল চালিকাশক্তি ছিল কিছু বিশেষ আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চেতনা। পাকিস্তানি
রাষ্ট্রের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, সামরিক স্বৈরতান্ত্রিকতা এবং শাসন, শোষণ ও বৈষম্য
প্রদর্শনের বিরুদ্ধেই মূলত ছিল বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালিদের আন্দোলন- সংগ্রাম, যার সর্বাগ্রগণ্য
নেতৃত্বে ছিলেন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ডাকেই ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষ বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত লাভলভ্যের চিন্তা পরিহার
করে, দেশ ও দেশবাসীর সার্বিক লাভ ও স্বার্থে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক, শোষণ-বৈষম্যহীন
এবং উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রধান লক্ষ্য।
কিন্তু
একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পরপরই কিছুসংখ্যক মানুষ তখনকার
সেই ধ্বংসপ্রায় মৃত্যুপুরীতে লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
এবং তাঁর দক্ষিণহস্ত বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন ও অন্যান্যরা যখন প্রায় শূন্য থেকে দেশকে গড়ে
তুলতে ব্যস্ত, তখন গোপনে এদেশেরই স্বল্পসংখ্যক রাজনীতিক এবং বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা
জাতির পিতা এবং তাঁর চার সহযোগীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
যার
ফলে, স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথাতেই নিহত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং
তাঁর প্রধান সহযোগী চার জাতীয় নেতা। বিশ্বের জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর তালিকায়
বাংলাদেশের এসব হত্যাকাণ্ডের কথাও কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী
ও মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা অনুযায়ী ঘাতকরা সেদিন
শুধু একজন রাষ্ট্রপতিকেই হত্যা করেনি, আমাদের জাতির পিতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকেই
হত্যা করেছিল। হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত
বাংলাদেশের ভিত্তিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে পাকিস্তানি কায়দার সামরিক ও সাম্প্রদায়িক
ধারায় দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
হত্যাকারীরা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহী ও মানবতার শত্রæ।
স্বাধীনতার
সারথীদের এভাবে নির্মূল করে ফেলার পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার আদর্শ, উদ্দেশ্য
এবং চেতনাকেও মুছে ফেলার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় নেতৃত্ব দেয় বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। পাক
দালাল রাজাকার আলবদরদের সে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড
মওকুব করে দিয়ে তাদেরকে সমাজে পুনর্বাসিত করেছিল, নির্বাসিত বা পলাতক রাজাকারদের দেশে
ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছিল, তাদের অনেককে নিয়েছিল নিজের মন্ত্রিসভায়, পরিবারের বহু সদস্যসহ
বঙ্গবন্ধু এবং কারভ্যন্তরে চার নেতাকে মারার জন্যে সে যাদের নিয়োগ করেছিল, সেই সেনা
সদস্যদেরও সে ইনডেমনিটির আওতায় এনে তাদের বিচারকাজ বন্ধ করে দেয়, এবং বিদেশে বিভিন্ন
দূতাবাসে নিয়োগ দিয়ে দেশত্যাগের সুযোগ করে দেয়। সেনাবাহিনীর ভেতরে সে পাল্টা অভ্যুত্থান
বা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে এবং অভিযুক্তদের আত্মসমর্থনের কোনো সুযোগই না
দিয়ে সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচারের তথাকথিত রায়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে বা ফাঁসির দড়িতে
ঝুলতে পাঠায় হাজার দুই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে।
জিয়াউর
রহমানের দুষ্কর্মের ইতিহাস বলে শেষ হবে না। স্পষ্টতই একজন পাকিস্তানি এজেন্ট জেনারেল
জিয়া ১৯৭৫-এ জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর যে অন্ধকার যুগের সূচনা করেছিল,
তা চলেছে একটানা দুটি দশক। জিয়ার নিজের, তার উত্তরসুরী লেজেহোমো এরশাদের, এবং তার যোগ্য
সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার শাসনাধীন একুশটি বছরে দেশ পিছিয়ে গেছে একশ পা, গণতান্ত্রিক
প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রায় হয়ে দাঁড়ায়, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার মন্ত্রীদের গাড়িতে উড়তে তাকে
স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, জাতির পিতার হত্যাকারীরা দাপিয়ে বেড়াতে তাকে দেশে-বিদেশে
প্রবল প্রতাপে।
এই
ঘোর অন্ধকার সময়কালে দেশ ও জাতির একমাত্র সান্ত¡না আর আশার আলো ছিল জাতির পিতার সুযোগ্যা
কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৯৬-এ দীর্ঘ দুদশকের
ব্যবধানে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এসেই প্রগতির পথে
আবার বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির চাকা ঘুরিয়ে দেন তিনি।
বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগের প্রকাশনা ‘গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য ও সম্ভাবনার
নতুন দিগন্ত’-তে বলা হয়েছে:
“১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে
সপরিবারে হত্যা করা হয়। সূচিত হয় উল্টোরথের যাত্রা। দীর্ঘ ২১ বছরব্যাপী জাতির বুকে
চেপে বসে সামরিক-অসামরিক নানা পোশাকের হিংস্র স্বৈরশাসন। স্বৈরতন্ত্র কেবল লুটপাট করেই
ক্ষান্ত হয়নি। তারা যেমন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে উঠতে দেয়নি, তেমনি সীমিত
সম্পদের এই দেশের উন্নয়নের সুযোগগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের কপালে দারিদ্র্য
ও অনগ্রসরতার কলঙ্ক চিহ্নটি আজও মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।
“এই দৃশ্যপটের পরিবর্তন সূচিত হয়
১৯৯৬ সালে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এক বিজয়ী গণআন্দোলনের
পটভূমিতে ওই একই বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচনে
জয়লাভ করে দেশ সেবার দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও গতিশীল নেতৃত্বে
আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৯৬-এর ২৩ জুন থেকে ২০০১ সালের ১২ জুলাই পর্যন্ত) পাঁচটি বছর রাষ্ট্র
পরিচালনায় স্থাপন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ... ফলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল
বাংলাদেশ। জাতির মনে সঞ্চারিত হয়েছিল নতুন আশাবাদ।”
কিন্তু
২০০১-এ কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করলে জাতির অগ্রগতি
আবারও প্রবলভাবে ব্যাহত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়াও
তার স্যাঙাতদের এবং বেগম জিয়াসহ অন্যান্য বিএনপি নেতাদের বেপরোয়া লুটপাটে দেশের অর্থনীতি
পরিণত হয় তলাবিহীন ঝুড়িতে, এবং বাংলাদেশ পরপর কয়েক বছর বিশে^র সর্বোচ্চ দুর্নীতিবাজ
দেশের স্বীকৃতি পায়। বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে
থাকে। শেখ হাসিনার প্রাণনাশেরও চেষ্টা চালানো হতে থাকে। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট ঢাকায় শেখ
হাসিনার এক জনসমাবেশে চালানো ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ
হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ দলের বহু
নেতা-কর্মী।
আরো
বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে ২০০৯-এর সাধারণ নির্বাচনে আবারও বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ
সরকার গঠন করে। পরবর্তী তিনটি নির্বাচনেও পর পর জয়ের সুবাদে প্রায় দেড় দশক টানা ক্ষমতায়
থাকার সুবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উন্নয়ন
কর্মকাণ্ড অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে পারায়, তার সুফল জনগণ ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু
এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে কথা বলতেন, সোনার বাংলার কথা বলতেন, তা
শুধু দারিদ্র্যমোচনের মধ্যেই ছিল সম্ভব। দারিদ্র্য বিমোচনের মহৌষধ হল অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পূর্তি হয়ে গেছে গত বছর। এর মধ্যে বিগত মাত্র ১৩-১৪ বছর ধরে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই আমাদের উন্নয়নের পালে জোরেশোরে হাওয়া লেগেছে। উন্নয়নের
গতি ত্বরান্বিত হয়েছে, যা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে। ইতোমধ্যে আমরা নিম্নমধ্যম উন্নয়নশীল
দেশ হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছি। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত ১২ বছরে ৬.৫০
শতাংশ থেকে শুরু করে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৭’র শেষদিকে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল
১,৭৫২ ডলার। অতিসম্প্রতি প্রকাশিত সরকারি তথ্যানুসারে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় দাড়িয়েছে
প্রায় দুহাজার ডলারে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা মেট্রোরেল প্রভৃতি মহাপ্রকল্পসহ
অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প এ সরকারের আমরে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে
তৃতীয় বিশে^ উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি
ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য প্রতিবেশী অনেক দেশের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে এবারের বিজয় দিবসে আমাদের শপথ নিতে হবে, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজাধারী কোনো দলের ক্ষমতায় আসা আমরা জাগ্রত জনতা গণরায়ের মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেবই। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে এসে আমরা আর কোনোভাবেই স্বাধীনতার চেতনাকে বিপন্ন হতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রগতি ও উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত হতে দিতে পারি না। আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী করে দ্বাদশ সংসদে আনতে না পারলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দেশের শাসনভার টানা চতুর্থবারের মতো তুলে দিতে পারলে, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিত্বের অস্তিত্ব আবারও বিপন্ন হযেই শুধু পড়বে না, পুরোপুরি নির্মূলও হয়ে যেতে পারে, যেমনটা হয়েছে মধ্য ও দক্ষিণ এশীয় এবং আফ্রিকান কিছু দেশে। জাতির মানচিত্র আঁকড়ে থাকা পুরোনো শকুনরা আবারও ক্ষমতায় এলে আমরা যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্বের মধ্যে পড়বো, সেটা থেকে আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবো কিনা সন্দেহ। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নর্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে উদযাপন করতে পারলে তবেই এবারের বিজয় দিবস সফল ও সার্থক হবে বলে আমরা মনে করি।