চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বয়স ১৩৬ বছর? মাত্র! দক্ষিণ ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে ও বঙ্গোপসাগরের কোলে অবস্থিত এই বন্দর ১৩৫ বছর পার করে দিল-- এমন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। বস্তুত এবারই প্রথম নয়, প্রতিবছর এই সময়ে সংবাদমাধ্যম আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেশের প্রধানতম সমুদ্রবন্দরের ‘জন্মদিন’। বন্দর কর্তৃপক্ষও দিনটিতে নানা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করে। প্রতি বছর সকালে বন্দর ভবনে জাতীয় ও বন্দরের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এ সময় বন্দরে অবস্থানরত সব নৌযান ও জাহাজ একযোগে এক মিনিট ধরে হুইসেল বাজায়। পরে হয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়, বন্দরের মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা, ঐতিহ্যবাহী মেজবান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনেকে বলেন ও লেখেন- ১৮৮৭ সালের ২৫ এপ্রিল বন্দরটি ‘প্রতিষ্ঠিত’ হয়েছিল। আসলে কি তাই? কোথাও একটি বড়সড় ভুল হচ্ছে না তো? উপমহাদেশে ব্রিটিশদের আগমনের আগেও কি চট্টগ্রাম বন্দর ছিল না?
মনে রাখতে হবে, কলকাতা বন্দর যেমন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর সুতানুটি গ্রামের
কাছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্যের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। বস্তুত বঙ্গোপসাগরের গভীর অথচ সংকীর্ণ যে কোণে
চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থিত-- প্রাকৃতিকভাবেই বন্দরের জন্য এমন উপযুক্ত স্থান বিশ্বে
খুব বেশি নেই। প্রাকৃতিক কারণেই ওই এলাকায়
সামুদ্রিক ঝড়ের ঝাপটা কম লাগে; সৈকতজনিত ঢাল না থাকায়
তীরের অনেক কাছে এসে সামুদ্রিক জাহাজ ভিড়তে পারে। এখন জানা যাচ্ছে, প্রাচীন
স্থল ও নৌ বাণিজ্য নেটওয়ার্ক সিল্করুটের একটি শাখা চট্টগ্রামকেও স্পর্শ করেছিল। সেকারণে সুদূর অতীত থেকেই চট্টগ্রামে ভিড়ত
সামুদ্রিক নৌযান, বাণিজ্য বহর। বন্দর ছাড়া এই বাণিজ্য কীভাবে সম্ভব?
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মালয় জাতির ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধগুপ্ত
নামে একজন নাবিক প্রথম চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে সেখানে গিয়েছিলেন। সেটাও চারশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে-- আজ থেকে প্রায়
আড়াই হাজার বছর আগে। খ্রিস্টের জন্মের
কয়েক দশক পর লিখিত ‘পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থেও পাওয়া যায় চট্টগ্রাম
বন্দরের নাম। পরে আরব বণিকরা মেঘনা-গঙ্গা নদী দিয়ে বাংলা, বিহারে প্রবেশের জন্য বেছে নিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর। ফা হিয়েন, হিউ এন সাঙ,
ইবনে বতুতা প্রমুখ পরিব্রাজকও উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করেই পরে ইউরোপীয়,
চীনা, তুর্কি বণিকরা এসেছে। পর্তুগিজ, মগরা
জলদস্যুতা করেছে। সেই ১৫১৭ সালেই পর্তুগিজ
ক্যাপ্টেন হোয়াও দ্য সিলভেইরা তার জাহাজ ‘লোপো সোয়ানা’ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে
এর নাম দিচ্ছেন ‘পোর্তো গ্রান্দে’-- গ্রেট পোর্ট-- বৃহৎ বন্দর। পর্তুগিজ ঐতিহাসিক
১৫৫২ সালে চট্টগ্রামকে বর্ণনা করেছেন ‘বাংলার সবচেয়ে খ্যাতিমান ও সম্পদশালী শহর’ হিসেবে।
বস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর মুঘলদের কাছে
হারানোর পর থেকেই আরাকান রাজাদের পতন শুরু হয়।
ইতিহাসের তুলনায় চট্টগ্রাম
বন্দর মুঘল ও ব্রিটিশদের দখলে যাওয়া তো ‘সেদিনের কথা’। আসলে সংশ্লিষ্টরা ভুল করছেন ব্রিটিশ শাসকদের ‘পোর্ট
কমিশনারস অ্যাক্ট’ পাস হওয়ার দিনটিকে খোদ বন্দরের জন্মদিন হিসেবে গণ্য করে। ১৮৮৭ সালের ২৫ এপ্রিল ছিল দিনটি। অনেকে জেনে অবাক হবেন যে, কুতুবদিয়া বাতিঘরের ইতিহাসও এর থেকে পুরনো। ১৮২২ সালে কর্ণফুলী মোহনার ৪০ মাইল দূরে
কুতুবদিয়া দ্বীপে এটি নির্মাণ করেন ক্যাপ্টেন হেয়ার ও ইঞ্জিনিয়ার জে এইচ টুগুড। পাথরের ভিত্তির ওপর নির্মিত বাতিঘরটির উচ্চতা
ছিল ১২১ ফুট । পাকিস্তান আমলে লোহা দিয়ে বর্তমান বাতিঘর নির্মিত হলে পাথরের
প্রাচীনটি পরিত্যক্ত ও ধীরে ধীরে লয় হয়ে যায়। এ কথা পাগলেও মানবে না যে বন্দরের আগে বাতিঘর
স্থাপিত হয়েছিল!
ইতিহাসকে সাক্ষী মেনে প্রশ্ন
করা যায়, ১৩৬ বছরের পুরনো হওয়ার কথা বাদ
দিন। প্রশ্ন করুন চট্টগ্রাম উপমহাদেশের
প্রাচীনতম বন্দর কিনা? হতেও পারে। গবেষকরা খোঁজ নিন।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক