আল্লাহ্‌র দান আল্লাহ্‌কে ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তুতির পরীক্ষাই কোরবানি


প্রকাশিত : শনিবার, ২০২২ জুলাই ০৯, ০১:৩৫ অপরাহ্ন

মহান আল্লাহর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির গুরুত্ব। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তার একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। ঈদুল আজহা শুধু পশু কোরবানি করা এবং আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আনন্দ প্রমোদকে বুঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ, নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র রবের সন্তুষ্টি। ঈমান আনায়নের মাধ্যমে সবাই মুমিন বা মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ঈমান গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি মুমিন ইসলামের সব বিষয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে। সুখ-দুঃখ এবং সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় ইসলামই একমাত্র অনুশাসন একথাটি নিজের মধ্যে দৃঢ় করে নেয়া। প্রকৃত মুমিনের মৌলিক চিন্তা চেতনা এমন হওয়াটাই কাম্য।

 

ঈদ মুসলিম এবং প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার অনন্য মাধ্যম। ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ নিষেধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা। ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশি এ কথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি কজনই বা গুরুত্ব দিচ্ছি! ঈদ যেমনি আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন মানসিকতা বিসর্জন দেওয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায় নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার। তাই আসুন ঈদুল আজহার প্রকৃত মহত্ত্ব ও তাৎপর্য নিজে লালন করতে শিখি। অসুন্দর ও কলুষিত হৃদয় পবিত্র করার লক্ষ্যে ঈদুল আজহায় শিক্ষা গ্রহণ করি। করোনার এই দুর্যোগ ও মহামারীতে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। অন্য সময় দান সদাকাহ এবং সহযোগিতার পরিমাণ যেটুকু ছিল এখন সেটা আরও বাড়াতে চেষ্টা করি। সবিশেষ সবার প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই।

 

কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহংকার মুক্ত হতে হবে। অনেকই বাহবা পাওয়ার জন্য ও নাম জাহির করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার পশু কিনে লাল ফিতা বেধে রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শিত করে থাকেন এট যেমন ঠিক নই, তেমনি কোন সামর্থবান ব্যক্তির জন্য কম দামি দুর্বল পশু কোরবানিও অনুচিত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেইটা আল্লাহর কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় নই। পশুর গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না বরং তাকওয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন। ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দ-এটি কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসুল (সা.) কোরবানির তিনভাগের একভাগ গোশত গরিবদের মধ্যে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। এমনকি সবটা দান করাও বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ তবে গরিবদের মাঝে বিতরণের যে উদ্দেশ্য তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শুধু পশু নয়, নিজের অন্তরের পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সঙ্গে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে।

 

এ কোরবানি শুধু যে পশু কোরবানি নয়, তা মানুষের ভেতরের অহঙ্কারি পশুর, মানুষের ভেতরের রক্তাক্ত অমানুষের বিনাশের প্রতীকী ত্যাগ। এর সঙ্গে সঙ্গে এ বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি অন্যতম প্রয়াস এই কোরবানি। এতে ব্যক্তির দেহের ও মনের ঋণাত্মক যত ভাবনা, অমানবিক যত চেতনা, মানবিকতার পরিপন্থী যত উপলব্ধি ও অহংকার এবং মানুষের মনের অন্তর্গত হিংস্র পশুত্বের যে অপচ্ছায়া তা অপসারিত হয়। এটাই নজরুলের কবিতায় উঠে আসা কোরবানির মর্মগাথা। এ ধারায় নজরুলের ‘বকরি ঈদ’ (সওগাত, ১৩৩৪) কবিতাটিও বিষয়-প্রাসঙ্গিকতায় অভিন্ন। এ কবিতাটি উপলব্ধির অন্তঃপুরে ত্যাগের মহিমাকে শোভান্বিত করে তুলেছে। এ কবিতায় নজরুল কোরবানির ঈদ মানবিক চেতনায় মহিমান্বিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন-‘শহীদানের ঈদ এলো বকরিদ। /...তাহারাই শুধু বকরিদ করে জানমাল কোরবানে’। ঈদ প্রসঙ্গ নিয়ে নজরুলের এমন আরও অনেক কবিতাই রয়েছে, যা এ সীমিত পরিসরে তুলে আনা সম্ভব নয়। বস্তুত নজরুল সাহিত্যে ধর্ম-সাম্য-দ্রোহ ও ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির শিল্পরূপ বিকাশের সঙ্গে বিশ্বমৈত্রীর প্রত্যয়ী নজরুলকেও আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি।

 

কোরবানির সুমহান শিক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবনযাপন। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহতায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশ ঘটেছে। হজরত আদম-পুত্র হাবিলের কোরবানি আল্লাহতায়ালা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই। কোরবানির অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আজহার নামাজে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-ইয়াতিমের মধ্যে কোরবানির গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয়া যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের অধিকার রয়েছে। কোরবানি মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহীদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এবং ইখলাস ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে।

 

দেশের অর্থনীতির সঙ্গে কোরবানির এক নিবিড় ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। তাই প্রসঙ্গত এ নিয়েও সব সময় ভাবনা কাজ করে। সে ভাবনা থেকে করোনাভাইরাস ৪র্থ ঢেউ এবং বন্যাজনিত কারণে এবারের পশু কেনাবেচা এবং পশুর চামড়া কেনাবেচায় বড় ধরনের ধাক্কা সামলাতে হবে আমাদের। যে ধাক্কা সামলাতে না পারলে সোজা আঘাত হানবে দেশের অর্থনীতিতে।

 

জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মুসলমানদের অন্যতম একটি উৎসব ঈদুল আজহা পালিত হবে। প্রতি বছর এ সময়ের আগেই বাংলাদেশে গরু-ছাগল কেনাবেচা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা অনেকটা কমে যাওয়ার পর গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ জুড়ে বহু ছোট-ছোট খামার গড়ে উঠেছে, যার মূল লক্ষ্য থাকে কোরবানির পশুর হাট। গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু-ছাগল লালনপালন করে। কোরবানির পশু যদি বিক্রি কম হয়, তবে লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে খামারিদের। সেই সঙ্গে এবার চামড়ার বাজারও ধসে পড়বে। এতে করে দেশের অর্থনীতি অনেকখানি ধাক্কা খাবে। পরিশেষে এ কথা বলতে পারি যে, ঈদুল আজহা উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানি হবে। পশুর চামড়া সংরক্ষণ, বাজারজাত করণে পরিবহন শৃঙ্খলাসহ পশু জবাইয়ের পর পশুর রক্ত, ময়লা আবর্জনায় যাতে পরিবেশ নোংরা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেন না এতে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি ও হুমকিতে পতিত হয়ে করোনা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়গুলোতে বিশেষ নজর দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

 


প্রধান সম্পাদক : জ্যোতির্ময় নন্দী
প্রধান নির্বাহী :  জামাল হোসাইন মনজু

ব্যবস্থাপনা সম্পাদক :   অভ্র হোসাইন 

প্রকাশক ও চেয়ারম্যান : অর্ক হোসাইন

 

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :

এপিক ইত্তেহাদ পয়েন্ট [লেভেল-৪]

৬১৮ নুর আহমদ রোড

চট্টগ্রাম-৪০০০।

Newsroom :

Phone : 01700 776620, 0241 360833
E-mail : faguntelevision@gmail.com

© ২০২২ Fagun.TV । ফাগুন টেলিভিশন কর্তৃক সর্বসত্ব সংরক্ষিত
Design & Developed by Smart Framework