পাহাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের উচ্চতা বোঝা যায় না। পাহাড়ের উচ্চতার একটা সঠিক ধারণা পেতে হলে তার কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে তার দিকে তাকাতে হয়। আমরা আজকে আমাদের বিস্ময় বিস্ফারিত দুনয়ন মেলে তাকাতে চাইছি এক আকাশ ছোঁয়া পর্বত শিখরের দিকে, দিন দিন যার শির ক্রমসমুন্নত হয়ে উঠছে।
এই শিখরের নাম শেখ হাসিনা, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের প্রিয় নেত্রী,
জাতির চোখের আলো, কণ্ঠের ভাষা, গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। বিংশ শতকের শেষ দুদশক থেকে একবিংশ
শতাব্দীর প্রথম দুদশকব্যাপী সময়ে শেখ হাসিনার উত্থান ও অগ্রযাত্রা আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ
এক সপ্রশংস বিস্ময়।
পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বিদেশে নির্বাসিত থাকা অবস্থাতেই শেখ
হাসিনা ১৯৮১’র ১৬ ফেব্রু য়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তার ঠিক তিনমাস
পর তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। সেবছরের ১৭ মে শেখ হাসিনা যখন ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখলেন,
তখন আমাদের তরুণ বয়স। সেদিনের সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে। বাবা মা ভাই
বোন সবাইকে হারানো, শোকে তাপে বিপর্যস্ত্, বছরের পর বছর ধরে বিদেশে লুকিয়ে আত্মরক্ষা
করতে করতে ক্লান্ত, রোগা শরীরের একটা মেয়ে, যে নাকি দুটো শিশুসন্তানের মা, তাঁকে খুব
মনে পড়ে। মনে পড়ে তাঁর অশ্রুপ্লাবিত চোখ, আর তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত উতরোল আবেগমুখর
জনগণকে দেওয়া তাঁর অবিনশ্বর প্রতিশ্রুতি।
সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির আগে বাংলাদেশের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে কেউ রাজনীতিক
হিসাবে শেখ হাসিনার নাম শোনেনি। তাঁর সেদিনকার ভাষণটিই ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক
দলের নেত্রী হিসেবে দেওয়া তাঁর প্রথম ভাষণ। অবশ্য বাংলাদেশের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয়
রাজনৈতিক পরিবারের জ্যোষ্ঠ সন্তান হিসাবে রাজনীতির সঙ্গে যে তাঁর অতিঘনিষ্ট পরিচয় ছিল
তাতে সন্দেহ কী? বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের (সাবেক ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট
গার্লস কলেজে) ছাত্রী থাকা অবস্থায় ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৬৬-তে তিনি ছয়
দফা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। তখন আন্দোলনের বহু
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঢাকার ৩২ ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনেই গৃহীত হয়, এবং তাঁর
বড় মেয়ে হাসিনা ছিলেন সেসবের প্রত্যক্ষদর্শী। এসব ঘটনা তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঝুলিকে
সমৃদ্ধ করেছে।
জন্মের পর থেকেই পিতার সংগ্রামী জীবন দেখে এলেও, তখন হয়তো তিনি নিজেই জানতেন
না, এই সংগ্রামই তাঁর সঙ্গী হবে জীবন জুড়ে। তিনি যে ভবিষ্যতে রাজনীতি করবেন বা তাঁর
বাবার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নেবেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত
হয়ে দেশের হাল ধরবেন, এ কথা তখন কেউ হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি। দেশের প্রতিভাবান তরুণ বিজ্ঞানী
এম. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে যথাসময়ে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি
যখন ঘটছে, তখন তিনি দুটি শিশুসন্তানের মা, এবং স্বামীর সঙ্গে তাঁর কর্মস্থল জার্মানিতে।
তাঁর ছোটবোন, তাঁর পিতৃপরিবারের তিনি ছাড়া আর একমাত্র সদস্য শেখ রেহানাও তখন তাঁর সঙ্গে।
দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নির্বাসিত কন্যা হিসাবে তাঁর তখন খুব
অসহায় দুরবস্থা।
ঘাতকের ছায়া পিছু নিয়ে দীর্ঘ ছয়টি বছর দেশে দেশে আত্মগোপন করে কাটিয়ে অবশেষে
যখন তিনি দেশে ফিরলেন, তখন কিন্তু দেশবাসী শেখ হাসিনার ভিন্নরূপ দেখতে গেলো। পঁচাত্তর-পরবর্তী
সময়ের বাস্তবতা যে তাঁকে পোড় খাওয়া ধারালো ইস্পাতে পরিণত করেছে, সেটা বোঝা গেলো তাঁর
পরবর্তী পদক্ষেপগুলোতে।
১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত টানা আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে সত্যি সত্যিই সামরিক স্বৈরশাসনের
অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করলেন তিনি। এ সময়কালের মধ্যে তাঁকে অন্তত দুবার গৃহবন্দি
করে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘির ময়দানে এক জনসভায় যোগ দিতে গেলে তৎকালীন
শ্বৈরশাসক লেজেহোমো এরশাদ পেটোয়া পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে।
চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের নেতা-কর্মীরা মানবঢাল রচনা করে তাঁকে রক্ষা করলেও,
সেদিন পুলিশে গুলিতে নিহত হল প্রায় ৩৪ জন মানুষ, আহত হন আরো অনেকে।
ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের চাপে এরশাদ শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেও, সামরিক
স্বৈরশাসন এবং স্বাধীনতা-বিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদের অপচ্ছায়া সম্পূর্ণ দূর হয়নি। ১৯৯০-এর
নির্বাচনে তাদের পেটোয়া তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বদৌলতে বিএনপি জিতে গেলো ভোটচুরির নির্বাচনে।
শেষপর্যন্ত ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দেশরতœ শেখ
হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সরকার গঠন করেন। এরপর ২০০৯, ২০১৪ ও
২০১৯-এর নির্বাচনগুলোতেও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে তিনি পরপর তিনবার এবং মোট চারবার
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন
করেন।
১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই যে সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক,
এতে এখন দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। তাঁর হাত ধরে এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং উন্নয়ন
পৌঁছে গেছে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ উচ্চতায়। শুধু এদেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের অনেক
জনপ্রিয়, ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদও এগুলো স্পর্শ করতে পারেননি। এ অর্জন
অনন্য ও অতুলনীয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ কন্যা স্বাধীন বাংলাদেশে পিতার মতোই
সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক।
দেশনেত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে শেখ হাসিনার কৃতিত্বগুলোর উপর বিহঙ্গদৃষ্টিতে
একবার চোখ বোলানো যাক:
১. ১৯৮১ থেকে ২০২২-- টানা ৪০ বছর ধরে তিনি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী
লীগের সভাপতি।
২. নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেছেন চারবার এবং সরকার পরিচালনা করছেন টানা বারো
বছরসহ মোট সতেরো বছর।
৩. ’৭৫-পরবর্তী সময়ে তিনিই সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক
চেতনার বিরুদ্ধ শক্তিকে পরাভূত করে বিপন্ন গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেন এবং জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় ইতিহাসের সঠিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যান।
৪. খন্দকার মোশতাক সরকার প্রবর্তিত কুখ্যাত
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির পিতার হত্যাকারীদের, স্বাধীনতা-বিরোধী কুখ্যাত
রাজাকার নেতাদের এবং জঙ্গি সন্ত্রাসিদের বিচার ও ফাঁসি নিশ্চিত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
করেছেন।
৫. একত্রিশটিরও বেশি আন্তর্জাতিক পদক ও স্বীকৃতি।
৬. লিখেছেন চল্লিশটিরও বেশি বই।
৭. বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু, সম্পূর্ণ
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুসহ অবকাঠামো উন্নয়নে নবযুগের সূচনা করেছেন।
৮. দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১২ বছর আগের তুলনায় চার গুণ বাড়িয়ে ২,২২৭ ডলারে
এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সর্বকালের রেকর্ড উচ্চতায় ৪৮.৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে
গেছেন।
৯. এইচডিআই-সহ সব ইনডেক্সে বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছেন বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাতারে।
১০. বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে সফল উপগ্রহ (বঙ্গবন্ধু-১) উৎক্ষেপণ করেছেন, এবং
বঙ্গবন্ধু-২ উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সারা বিশ্বের চোখে শেখ হাসিনা এক বিস্ময় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর সমুদ্রবিজয়
(নীল অর্থনীতি), ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার সমাধান, পার্বত্য শান্তিচুক্তি
সম্পাদন, বাংলাদেশকে পারমাণবিক বিদ্যুৎযুগে নিয়ে যাওয়া, ঢাকায় মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামে
কর্তফুলি টানেল নির্মাণ, আইসিটি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন, সফলভাবে করোনা মোকাবিলা
প্রভৃতি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও সাফল্যের মাধ্যমে। চিরকালের খাদ্যাভাবের একটি দেশকে
তিনি খাদ্যে স্বয়ংস্বম্পূর্ণ করে তুলেছেন। খাদ্যশস্য উৎপাদনসহ কৃষির সব খাতে তিনি নিয়ে
এসেছেন অচিন্ত্যনীয় সফলতা। দেশের লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষকে গৃহ দিয়েছেন।
বহু দুঃখ-কষ্টের, শোকতাপের, নিপীড়ন-নির্যাতনের আগুনে পুড়তে পুড়তে শেখ হাসিনা
আজকের নিখাদ সোনার তুল্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠছেন। প্রতি পদে পদে তিনি শিখেছেন নিজের জীবন
থেকে, যে-জীবন মহাকাব্যিক মহিমায় সমুজ্জ্বল। জীবন তাঁকে শিখিয়েছে কিভাবে ঘাতক নরপশুদের
হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে হয়, কিভাবে দুঃশাসন-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হয় প্রতিরোধের
প্রাচীর। জীবনের দুর্দিনগুলো তাঁকে চিনতে শিখিয়েছে প্রকৃত বন্ধুদের, চিহ্নিত করতে শিখিয়েছে
মিত্ররূপী শত্রুদের। তাঁর চোখে ছিল পিতার সোনার বাংলার স্বপ্ন, বুকে ছিল পিতার উত্তরাধিকার
হিসাবে পাওয়া অদম্য সাহস, আর সর্বোপরি ছিল তাঁর তথা জাতির পিতার ভাষায় “বাংলার দুঃখী মানুষের’ কল্যাণ করার দুর্দম স্পৃহা। এ
পুঁজিটুকু সম্বল করে সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি জনগণের ভোট আর ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায়
সারা দেশের গ্রাম গ্রামান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন।
১৯৯৬-এ সরকার গঠন করে তাঁর প্রথম যুগান্তকারী কীর্তি ছিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ
বাতিল করে জাতির পিতার খুনিদের বিচার ও দÐবিধানের পথ উন্মুক্ত করা এবং দেশে স্বাধীনতার
পক্ষের শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যে বঙ্গবন্ধুর নাম পঁচাত্তরের আগস্টের পর থেকে মুছে
ফেলা হয়েছিল, তাঁকে জাতীয় খলনায়কে পরিণত করা হয়েছিল, তাঁকেও তাঁর যোগ্য কন্যা এবং জাতির
যোগ্য নেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন পূর্ণ মহিমায়।
বৈশ্বিক করোনা মহামারির মধ্যেও দেশবাসীর জীবন ও জীবিকার মধ্যে বিস্ময়কর সমন্বয়
সাধনের মাধ্যমে জিডিপি ও রফতানি বৃদ্ধি, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন প্রভৃতিতে তাঁর ভূমিকা
সারা বিশ্ব বিস্ময়বিমুগ্ধ চোখে দেখে প্রশংসায় উচ্চকিত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি
নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ,
স্যানিটেশনসহ সব ক্ষেত্রে তাঁর সরকার যে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে, তা আজ কারো দৃষ্টির
অগোচর নয়, আর নয় বলেই বিশ্ব সম্প্রদায় যার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছে। শেখ হাসিনার
সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হচ্ছে এসডিজি বাস্তবায়ন পুরস্কারসহ বহু নতুন পালক, আর সেইসঙ্গে
বিশ্বসভায় বাংলাদেশ উঠে যাচ্ছে একটি সমৃদ্ধ মানবিক দেশ হিসেবে এক অনন্য উচ্চতায়। এভাবেই
আজকে শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনন-মেধা, সততা-নিষ্ঠা, প্রখর দক্ষতা এবং সৃজনশীল
উদারমুক্ত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত থেকে
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাঁর সফল ও ভিশনারি নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন দেখছে
২০৪১-এর মধ্যেই স্বল্পোন্নত থেকে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার।
একজন মানবিকতাবাদী নেত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা বিশ্বের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেন
বিশেষ করে পড়শি দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত নিপীড়িত রোহিঙ্গাকে
আশ্রয় দিয়ে। রোহিঙ্গা সংকটের মতো মানবিক সংকট
মোকাবিলায় তিনি যে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য সারা পৃথিবী তাঁকে সাধুবাদ
জানিয়ে ‘মানবতার জননী’ অভিধায় ভূষিত করেছে। সুদক্ষ ক‚টনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে একদিকে
যেমন তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন, তেমনি স্বদেশের
স্বার্থরক্ষায় বিশ্বসভায় জোরালো বক্তব্য তুলে ধরে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতাদের জন্য
অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন।
আমাদের বৃহত্তম ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে কোন্
উচ্চতায় উঠেছে, তার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফরে। তাঁকে যে আন্তরিক
উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে, তা দুদেশের অন্তরঙ্গতম সম্পর্কের পরিচয়বাহী। এ সফরে তিস্তার
পানি বণ্টনসহ অনেকগুলো বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, কুশিয়ারার পানি বণ্টন
নিয়েও অচিরেই একটা বোঝাপড়া হয়ে যাবে বলে উভয় পক্ষ থেকে জোর আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে,
সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতীয় মিডিয়া বর্ণাঢ্য ব্যাপক কভারেজ দিয়েছে। সবদিক
থেকে শেখ হাসিনার এ সফরকে একটা চূড়ান্ত সফল সফর বলা যায়।
স্মর্তব্য, গতবছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের
অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি (তৎকালীন) রামনাথ কোবিন্দ এবং প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতার এই হীরক জয়ন্তী বছরে ভারত সফরে গেলেন বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী। স্মর্তব্য, ভারতের হীরক জয়ন্তী স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজে বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকশ দলও অংশগ্রহণ করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য
করতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য নিহত বা মারাত্মক আহত হয়েছিলেন, সত্য ইতিহাস
ধরে রাখতে সদা সক্রিয় শেখ হাসিনা তাঁদের বংশধরদের জন্য তাঁর প্রবর্তিত ‘মুজিব বৃত্তি’ তুলে দিয়েছেন।
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন নৈকট্যের শীর্ষে আছে বলএ
অত্যুক্তি হবে না। শেখ হাসিনার সরকারের আমলের এই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে অনেকে ‘প্রতিবেশী ক‚টনীতির অনন্য অনুকরণীয় আদর্শ’ বলে অভিহিত করেছেন। সমগ্র উপমহাদেশে
শেখ হাসিনা এখন এক সফল অগ্রণী নেতার নাম হল শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আজ শিক্ষা,
স্বাস্থ্য, নারী অগ্রগতি প্রভৃতি নানা সূচকে এমনকি ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। উপমহাদেশের
অন্য দেশগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য।
নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন তাঁর ‘ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ বইটিতে লিখেছেন, “বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে, এ কথা কেউ ভাবেনি। স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেই তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশের
ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেউ কেউ তাকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে খরচের খাতায় ফেলে দিয়ে বলেছিলেন,
এদেশকে কোনো অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়াই উচিত নয়। কারণ, সে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন করে উঠতে পারবে না।.... অথচ জীবনমানের নানা সুপ্রচলিত মাপকাঠিতে
বাংলাদেশ (বর্তমানে) কেবল ভারতের চেয়ে অনেক ভালোই করছে না, ভারত থেকে অনেকটা এগিয়েও
গেছে। অনেক সামাজিক সূচক, যেমন-- গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুহার, টিকা প্রদানের হার, প্রজনন
হার এবং এমনকি স্কুলশিক্ষার কিছু মানদণ্ডে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে ।”
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থাতেই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের
দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাহেন্দ্রক্ষণ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী
পালিত হয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই
প্রকৃত অর্থে বাঙালিকে একড়ি সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংবিধান
দিয়ে গেছেন। ঘাতকদের হাতে নিহত হওয়ার আগে মাত্র সাঙে তিনটি বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি
উন্নয়নের যে ভিত্তি গড়ে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে আজ তা পূর্ণতা
পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বার বার আঘাত এসেছে। আল্লাহ্ রাহমানির রহিমের
অসীম রহমতে, দলীয় নেতা-কর্মী ও জনগণের সহযোগিতায় তিনি অবিরাম নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন
দুরন্ত দুর্বার গতিতে। তিনি আজ ১৭ কোটি মানুষের আশাভরসাস্থল, আত্মবিশ^াসের প্রতীক।
জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা নিয়ে তিনি এদেশের গণমানুষের কল্যাণে পরম মমতা, সততা ও দক্ষতা
নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম
সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মেহনতি মানুষের পক্ষে বাংলায় ভাষণ দিয়ে একজন বিশ্বনেতার
স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও পিতার মতোই জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ
পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়ে, এবং সে-ভাষণে বর্তমান বিশ্বের সমসাময়িক নানা বিষয়, যেমন করোনা
ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা, খাদ্যনিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিরসন প্রভৃতি
বিষয়ে প্রস্তাব উপস্থাপন করে পরিগণিত হচ্ছেন বিশ্বনেতারূপে। তিনি ‘টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক’ (এসডিএনএস)-এর মাধ্যমে এসডিজি
বাস্তবায়নে জাতিসংঘ পুরস্কার লাভ করেছেন এবং ‘ক্রাউন জুয়েল’ বা ‘মুকুটমণি’ অভিধা পেয়েছেন। প্রযুক্তিগত শিক্ষাদানে
সফলতার জন্যে পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার।
দক্ষিণ এশিয়ায় ক‚টনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায়
বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে অন্যান্য দেশ। করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক অতিমারিতেও বাংলাদেশকে
দাবিয়ে রাখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এই অনাকাক্সিŸত
পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। করোনা মোকাবিলার সক্ষমতায় বাংলাদেশ
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও বিশ্বে বিশতম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি
মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কোভিড-১৯
নিয়ন্ত্রণ এবং অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে জনগণের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি
ক্ষেত্রে বিশ্বের অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। নেত্রীর প্রতিশ্রু তির
বাস্তবায়নে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা আজ রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত
বিস্তৃত হয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড সুবিধা পৌঁছে দেওয়া
হচ্ছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর গণতন্ত্র সূচক ২০২০-এ চার ধাপ অগ্রগতি
হয়েছে বাংলাদেশের। ৫.৯৯ স্কোর নিয়ে সূচকে ১৬৫টি দেশ ও দুটি অঞ্চলের মধ্যে ৭৬তম অবস্থানে
রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর ৫.৮৮ স্কোর নিয়ে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮০তম। ৫টি মানদÐে
১০ পয়েন্ট ধরে বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির বিচার করে প্রতি বছর প্রতিবেদন
প্রকাশ করে (ইআইইউ)। এগুলো হলো: নির্বাচনী-ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারের সক্রিয়তা,
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার। এ তালিকায় ভুটান রয়েছে ৮৪তম,
নেপাল ৯২তম, পাকিস্তান ১০৫তম অবস্থানে। সামাজিক-অর্থনৈতিক-অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা
সূচকে আজকের বাংলাদেশের যে অগ্রগতি-অবস্থান তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিকট রোল মডেল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্নের সোনার বাংলা
প্রতিষ্ঠায় দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণকে রাজনৈতিক
মুক্তি প্রদান করেছেন, আর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ
নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে দেশের জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি প্রদান করার মাধ্যমে
বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে উন্নয়নশীল এবং মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
করেছেন। ২১০০-এর মধ্যে 'উন্নত বাংলাদেশ’ নির্মাণের কথা ভেবে ‘ডেল্টা প্ল্যান’ মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন
তিনি। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানব উন্নয়ন সূচকে শেখ হাসিনা দেশকে
সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সাহসিকতা
ও দূরদর্শিতার জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তিনি।
সারাবিশ্ব দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করছে ও প্রশংসা করছে। রাষ্ট্রনায়ক
হিসেবে তিনি বিশ্বমঞ্চের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। এভাবেই নিজ কর্মগুণে আজ তিনি পরিণত
হয়েছেন জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীতে।
বাংলাদেশের সরকার প্রধান বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনার সূর্য আজ মধ্যগগনে দেদীপ্যমান।
তাঁর কৃতিত্ব ও কীর্তির সুদীর্ঘ ইতিবৃত্ত এই স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। এবছর
তাঁর জীবনের হীরক জয়ন্তী বর্ষ। কারণ প্রাজ্ঞ প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ এবছরের ২৮ সেপ্টেম্বর
তাঁর কীর্তিবহুল জীবনের ৭৫তম বছরে পদার্পণ করছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাত্তরতম জন্মজয়ন্তীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রচিত
মানপত্রে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন: “তোমার সপ্ততিতম-বর্ষশেষে একান্তমনে
প্রার্থনা করি, জীবন-বিধাতা তোমাকে শতায়ু দান করুন; আজিকার এই জয়ন্তী-উৎসবের স্মৃতি
জাতির জীবনে অক্ষয় হউক।”
প্রিয় বিশ্বনেত্রীর ছিয়াত্তরতম জন্মজয়ন্তীতেও আমাদের এই একই প্রার্থনা। মহান সৃষ্টিকর্তা জাতির শিয়রে সদাজাগরূক এই মহান নেত্রীকে সুস্থ, কল্যাণকর্মময় শতায়ু দান করুন। আমাদের জাতীয় জীবনে এই জন্মদিন ফিরে ফিরে আসুক আনন্দ-কল্যাণের বার্তা নিয়ে।