ব্রিটিশ
রাজনীতিবিদ ঋষি সুনাক কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছেন এবং তাঁর
প্রতিদ্বন্দ্বী পেনি মর্ডান্ট সহকর্মী এমপিদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ১০০টি মনোনয়ন
পেতে ব্যর্থ হওয়ায় সুনাকই পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন।
‘সিনিয়র
ব্যাকবেঞ্চার গ্রাহাম ব্র্যান্ডি বলেছেন, মর্ডান্ট সাবেক অর্থমন্ত্রী সুনাকের
পক্ষে তাঁর ‘পূর্ণ সমর্থন’ দিয়েছেন।
সাবেক
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রোববার সরে দাঁড়ানোর পর সুনাক ও মর্ডান্টের মধ্যে
প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে মর্ডান্ট তার সহকর্মী এমপিদের প্রয়োজনীয়
সমর্থন না পাওয়ায় সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে আর কোনো বাধা রইল না।
রাজা
চার্লস তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুনাকের নাম ঘোষণা করবেন।
ক্ষমতাসীন পার্টি কনজারভেটিভ পার্টি
নেতা এবং সেই সাথে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঋষি সুনাকের নির্বাচন ব্রিটেনের
রাজনীতিতে একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা।
কারণ এই প্রথম ব্রিটেনে একজন ভারতীয়
বংশোদ্ভূত অভিবাসীর সন্তান, একজন অশ্বেতাঙ্গ ব্রিটেনের রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ পদে বসছেন।
সুনাকের বাবা-মা ভারতীয় পাঞ্জাবি
বংশোদ্ভূত হলেও তাঁরা থাকতেন পূর্ব আফ্রিকায়, এবং সেখান থেকেই তাঁরা ব্রিটেনে এসে
বসবাস শুরু করেন।
ঋষি সুনাকের জন্ম ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডের
বন্দরনগরী সাদাম্পটনে। তাঁর বাবা সেখানে চিকিৎসক ছিলেন। মা একটি ফার্মেসি চালাতেন ।
ফলে পরিবার ছিল বেশ সচ্ছল।
নাম করা প্রাইভেট স্কুল উইনচেস্টার
কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। গ্র্যাজুয়েশন করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পরে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে এমবিএ করেছেন। সেখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় ভারতীয় ধনকুবের এবং আইটি সেবা কোম্পানি
ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষতার সাথে। তারপর প্রেম এবং প্রণয়।
দুটো মেয়ে রয়েছে এই দম্পতির।
২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত সুনাক মার্কিন
বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান সাক্সে চাকরি করেছেন। পরে দুটো হেজ ফান্ডের অংশীদার ছিলেন
তিনি।
যেভাবে দ্রুত উঠে
এলেন ক্ষমতার রাজনীতিতে
ঋষি সুনাক ২০১৫-এ প্রথম উত্তর ইংল্যান্ডের
ইয়র্কশায়ার কাউন্টির রিচমন্ড এলাকার এমপি হন।
ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন
থেকে ব্রিটেনকে বের করে আনার পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। ব্রেক্সিট গণভোটের প্রচারণার সময়
পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন “আরো মুক্ত, আরো সমৃদ্ধ দেশ হবে।”
সেসময় তিনি শক্ত অভিবাসন নীতির
পক্ষে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, “যদিও আমি বিশ্বাস করি যথাযথ অভিবাসন নীতি দেশের জন্য মঙ্গলজনক, কিন্তু
সীমান্ত আমাদেরকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”
টেরিজা মে’র সরকারে ঋষি সুনাক স্থানীয় সরকার
বিভাগে জুনিয়র মন্ত্রী হন। পরে বরিস জনসন ক্ষমতা নেওয়ার পর তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিফ সেক্রেটারি নিয়োগ করেন।
বরিস জনসনের সাথে মনোমালিন্য তৈরি
হওয়ায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করলে ঋষি সুনাক
অর্থমন্ত্রী হন।
কিন্তু ২০২২-এ কোভিড লকডাউন ভেঙে
পার্টি করা এবং তা নিয়ে মিথ্যা বলার অভিযোগে প্রচণ্ড চাপে বরিস জনসন যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন,
তখন অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন সুনাক।
অনেকে মনে করেন, তাঁর পদত্যাগের
মধ্য দিয়েই বরিস জনসনের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। বরিস সমর্থকরা তিনি সুযোগসন্ধানী
বলে অভিযোগ আনলেও, সুনাক বলেছিলেন, নৈতিক কারণেই তখন তিনি সরে গিয়েছিলেন।
বরিস জনসনের পদত্যাগের পরপরই নেতৃত্বের
নির্বাচনে প্রার্থী হন ঋষি সুনাক। প্রচারণায় তিনি নিজেকে চৌকশ একজন আর্থিক ব্যবস্থাপক
হিসাবে তুলে ধরেন। তাঁর প্রচারণার প্রধান বার্তা ছিল: কোভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে
ব্রিটিশ অর্থনীতি ভীষণ সঙ্কটে এবং তাঁর প্রধান কাজ হবে এর সমাধান করা।
কিন্তু শেষপর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসে
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনের ভোটে তিনি লিজ ট্রাসের কাছে হেরে যান।
তাঁর সরকারের দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন
বাজেটে আর্থিক খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় দলের ভেতর প্রচণ্ড চাপে পড়ে
গত সপ্তাহে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস।
এর পরপরই আবারও নেতৃত্বের ব্যাপার
তার প্রার্থিতা ঘোষণা করেন ঋষি সুনাক। এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের নেতা নির্বাচিত
হয়ে যান।
মাত্র ৪২ বছরের মি. সুনাক হবেন
ব্রিটেনের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী, এবং ১৮১২ সালের পর থেকে এপর্যন্ত সময়ের মধ্যে সবচেয়ে
কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী।
‘আমি একজন হিন্দু’
ঋষি সুনাক ২০১৯-এ এক সাক্ষাৎকারে
বিবিসিকে বলেছিলেন, আত্মপরিচয় তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । “আমার বাবা-মা এদেশে এসে বসতি গাড়েন।
সুতরাং এমন একটি প্রজন্ম এদেশে রয়েছে, যাদের জন্ম এদেশে হলেও তাদের বাবা-মার জন্ম
অন্যত্র”।
তিনি বলেন, “আমার সাংস্কৃতিক প্রতিপালনের কথা
যদি বলি, তাহলে সপ্তাহশেষে শনিবার আমি মন্দিরে গেছি। আমি একজন হিন্দু, কিন্তু সেইসাথে
আমি সেন্টস্ (সাদাম্পটন ফুটবল ক্লাব)-এর ম্যাচের দিন মাঠে গেছি। দুটো কাজই করেছি। সবই
করেছি।”
ঐ একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি
সৌভাগ্যবান ছিলেন যে, বড় হওয়ার সময় তাঁকে খুব একটা বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হতে
হয়নি। কিন্তু একটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেন, যেটি তিনি কখনই ভুলতে পারেননি।
সুনাক বলেন, “ছোট ভাই ও বোনেকে নিয়ে একদিন বেরিয়েছি।
অল্পবয়স তখন, বছর ১৫ হবে। আমরা একটি ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। কাছেই কিছু
লোক বসেছিল। সেই প্রথম আমাদের লক্ষ্য করে তারা ‘পি’ শব্দটি ছুঁড়ে দিয়েছিল। ঐ শব্দ সেদিন আমার গায়ে ভীষণ
লেগেছিল। আমি এখনও তা ভুলিনি।”
তবে তিনি একইসাথে এও বলেন, “এখনকার ব্রিটেনে এমনটা ঘটবে বলে
আমি বিশ্বাস করি না।”